বাঘায় ভুঁইফোড় এনজিওগুলোর গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গার জীবন নগরে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এ বছর জুন মাসে লাপাত্তা হয়েছে গ্রামীন মানব কল্যান সংস্থা (ইউ.এস.এ.আই.ডি) নামে একটি এনজিও। বর্তমানে একই নামে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সদরে সাইনবোর্ড লক্ষ্য করা গেছে। যে ভবনে এই অফিস চালু করা হয়েছে, সেখানে এক সাথে রয়েছে আরো পাঁচ প্রতিষ্ঠান (সমিতি’র) সাইনবোর্ড। এ ছাড়াও পাশেই রয়েছে এসিসিএফ ব্যাংক লি.।

যার সবগুলোই পরিচালনা করছেন জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে জামানত নিয়ে চাকরি দেয়া-সহ এলাকা ভিত্তিক সমিতি খুলে চড়া সুদে ঋণ দেয়া। আমানত হিসেবে সঞ্চয় নেয়া হয়। এরপর কালের বিবর্তনে লাপাত্তা হয় সমিতিগুলো। এমনটি অভিযোগ করেছেন কয়েকজন ভুক্তভুগী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে , চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে একটি ভাড়া বাড়িতে অফিস চালু করে গ্রামীন মানব কল্যাণ সংস্থা নামের একটি এনজিও। গৃহিণীদের ক্ষুদ্র, কুটির ও হস্তশিল্পের আওতায় লাখ টাকা ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে গড়ে ৪০ জন নারীকে নিয়ে একটি করে সমিতি তৈরি করে ঐ সংস্থাটি। এরপর সঞ্চয় আমানত হিসেবে জন প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে সংগ্রহ করে মাঠকর্মীরা। যারা এই মাঠ কর্মীর দায়িত্ব পালন করে- তারাও প্রায় লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি নেন। এ ভাবে মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে বেশকিছু গ্রামে ৫০টি সমিতি তৈরি করে এই সংস্থাটি। এরপর কোটি টাকা নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ।

বর্তমানে বাঘার নূর প্লাজার দ্বিতীয় তলায় গ্রামীন মানব কল্যাণ সংস্থা নামে একটি এনজিও সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে সমগ্র বিশ্বের একটি আন্তর্জাতিক মানের আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত সেবা মূলক এই প্রতিষ্ঠান। তার পাশে একই ঘরের মধ্যে রয়েছে আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠান (সমিতি)। আর সাইনবোর্ড গুলো রয়েছে ছাদের সিলিং-এ।

এরা হলো- ঊষার আলো কোম্পানী লিমিটেড, সিটিজেন লিগ্যাল কনসালটেন্সি লিমিটেড, প্রত্যাশা সঞ্চয় ঋণদান সমবায় সমিতি ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশান। এ ছাড়াও পার্শ্বে সাত্তার প্লাজায় রয়েছে এ.সি.সি.এফ (আজিজ কো-অপারেটিব) ব্যাংক নামে তাদের আরো একটি প্রতিষ্ঠান। যার সবগুলো দেখভাল করছেন স্থানীয় জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক ব্যাক্তি।

তবে সোমবার বাঘায় ঊষার আলো (এস.টি.সি.বি.এল)কোম্পানী লিমিটেড এর নতুন অফিস উদ্বোধনকালে দু’জন ভুক্তভুগীর অভিযোগে জানা গেছে, এই ৭ প্রতিষ্ঠান পরিচালকের নাম। তিনি হলেন, মিজানুর রহমান। তাঁর বাড়ি পাবনা সদরে বলে জানা গেছে।

ওইদিন পাশ্ববর্তী লালপুর গ্রামের ভুক্তভুগী মনিরা ইয়াসমিন এবং বাগাতিপাড়ার আক্তার আলী পাওনা টাকার দাবি নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হন । এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

মনিরা ইয়াসমিন জানান, মানব কল্যাণ সংস্থায় চাকরি দেয়ার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ওই প্রতিষ্ঠান নগদ ২ লাখ এবং এসিসিএফ (আজিজ কো-অপারেটিব) ব্যাংকে ফিক্স ডিপোজিট হিসাবে জমা রাখার জন্য আরো ৩ লাখ টাকা নেয়। বর্তমানে তিনি ওই টাকা ফেরত চাইলে তারা টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। অপরজন বাগাতিপাড়ার আক্তার আলী তিনিও এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামীন মানব কল্যান সংস্থা(ইউ.এস.এ.আই.ডি) বাঘা শাখায় কর্মরত দু’জন অভিযোগ করে বলেন, জাহাঙ্গীর হোসেন ১১ মাস আগে জামানত নিয়ে আমাদের চাকরি দিয়েছেন। অথচ অদ্যাবিধি বেতন দিতে পারেননি। এখন ক্ষমা চেয়ে নতুন ভাবে উদ্বোধন হওয়া অফিস ঊষার আলো (এস.টি.সি.বি.এল) কোম্পানীর কর্মকর্তা হিসাবে সামনে মাসের ৫ তারিখ থেকে বেতন দিবেন বলে অঙ্গিকার করেছেন। অথচ ৬ মাস পুর্বেও জাহাঙ্গীর হোসেন ৪ বিঘা জমি কিনেছেন বলেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বাঘার আমোদপুর গ্রামের সাদেক আলী অভিযোগ করে বলেন, জাহাঙ্গীর হোসেন শুধু সমিতি আর এনজিও’ই দেখভাল করে-না। তার বিরুদ্ধে আমার এক আত্নীয়কে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়ার নামে সাড়ে ৮ লাখ টাকা প্রতারণার মামলা চলছে রাজশাহী চিপ জুডিশিয়াল আদালতে।

এদিকে একজন ব্যক্তি কি করে ৭ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছেন তা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এসিসিএফ (আজিজ কো-অপারেটিব) ব্যাংকে খুব শির্ঘই ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (সমিতি’তে) লোকবল কম থাকায় বস সবগুলো প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। তাঁর নামে আদালতে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা মামলা হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্খিত বলে তিনি দাবি করেন।

বাঘা পৌর সভার প্যানেল মেয়র শাহিনুর রহমান পিন্টু ও মোজাহার হোসেন মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাক্ষ নছিম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে যার যখন ইচ্ছে , কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে খুলে বসছেন সমিতি। নামমাত্র এসব সমিতি খুলে চড়া সুদের বিনিময়ে প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-সহ অনেককেই ঋণ দিচ্ছে তারা। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও টাকার প্রাচুর্য থাকায় একই কাজ করে চলেছে। এতে প্রতিনিয়ত চক্রবৃদ্ধি সুদের ফাঁদে পড়ছেন সুবিধা নিতে আসা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের মতে, প্রশাসন যদি এসব দাদন ব্যবসায়ীদের বাড়ি তল্লাশী করে তবে প্রত্যেকর বাড়ী থেকে পাবেন শত-শত ফাঁকা চেক এবং অসঙ্খ ষ্টাম্প।

উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুল মোকিম ও সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান জানান, সমিতি গড়ার অনুমতি তারা দিয়ে থাকেন তবে গঠনতন্ত্র মোতাবেক সমিতির যা উদ্দেশ্যে তার জন্য। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সমিতির নামে ঋণ প্রদান এবং সুদের ব্যবসা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে ।

বাঘা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন রেজা বলেন, যতটুকু জানি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান তাদের নামের সাথে ব্যাংক লিখতে পারবে না। সমবায় কিংবা সমাজসেবা থেকে সমিতি খুলে কেউ যদি উচ্চ সুদে ঋণ (দাদন) ব্যবসা চালায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।