বাংলাদেশে শারদীয় উৎসব নিয়ে কিছু কথা ॥ আহমদ রফিক

বাঙালির মধ্যে সংখ্যা বিচারে দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। এ ছাড়া রয়েছে অল্প সংখ্যক বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। পূর্বোক্ত দুই প্রধান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সামাজিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা ও ঈদ।

 

দুটোরই রয়েছে সর্বজনীন সামাজিক উসব-অনুষ্ঠানের চরিত্র। এ চরিত্র আধুনিককালের দান এবং তা ধর্মীয় চেতনার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেই পরিস্ফুট। এ সামাজিক উৎসবে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীর অংশগ্রহণে কোনো বাধা নেই। ধর্মীয় আচার আর সামাজিক আচার পাশাপাশি চলতে কোনো বাধা নেই।

 

শারদীয় দুর্গাপূজার বড় বৈশিষ্ট্য এর প্রেক্ষাপটে শারদ প্রকৃতি। শরতের স্বচ্ছনীল আকাশের আকর্ষণীয় রূপ, মাঝে মধ্যে সেখানে সাদা মেঘের ভেলা কবির কল্পনা নয়, বাস্তব সত্য। এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই গুচ্ছ গুচ্ছ শিশির ভেজা শুভ্র কাশফুল জমিতে বা ডোবার পারে আশ্চর্য সুন্দর ক্যানভাস যেন। তার চেয়েও কম আকর্ষণীয় নয় ভেজা শিউলির সুরভিত প্রকৃত পরিবেশ। বাতাসে তার মদির গন্ধ।

 

শারদ প্রকৃতির এমন আকর্ষণীয় পরিবেশে ঢাকের আওয়াজ বুঝিয়ে দেয় উৎসবের আগমনী। এর পেছনে রয়েছে পৌরাণিক ইতিকথা। মায়ের আগমন ও বিদায় যা শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। তবে এ কথাও সত্য যে একালে ধর্মীয় আচারের চেয়ে এর আনন্দ আবেগ উৎসবের ঘনঘটায় প্রধান হয়ে ওঠে। এতে প্রকাশ পায় সর্বজনীন চরিত্র।

 

উৎসব মানেই আনন্দ। আর এ ধরনের উৎসবে প্রধান হয়ে উঠে সাজ, পোষাক, অলংকার ছাড়িয়ে সামাজিকতার আন্তরিকতা। আপ্যায়ন ভোজনে যা প্রকাশ পায়। পায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সংকীর্ণতার প্রকাশ না ঘটিয়ে। যেমনটা দেখা যায় বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের রমজান শেষে ঈদ উৎসবে। তবে বাঙালি হিন্দুর শারদীয় উৎসবে সংস্কৃতি চর্চারও থাকে একটি প্রধান ভূমিকা। নাচ গান, নাটক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। এ চরিত্র রাজধানী ও শহর-প্রধান হলেও তা ছিল সম্পন্ন গ্রামীণ পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত। স্মৃতির ফিতেগুলোকে সক্রিয় করলে ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ পূজার প্রতীকী তাৎপর্য মনে পড়ে যায় : অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয়, সমাজে নিশ্চিন্তি ও শান্তির প্রতিষ্ঠা। এটাতো মানুষ মাত্রেরই কাম্য।

 

॥ দুই ॥
আমার শৈশবের প্রধান অংশ কেটেছে গ্রামের প্রকৃত সৌন্দর্যের পরিবেশে। আর কৈশোর প্রায় পুরোটাই প্রায় একইরকম মহকুমা শহরে, আজ থেকে প্রায় সাত/আট দশক আগের কথা।

 

নদীমাতৃক গ্রাম-বাংলার শারদ প্রকৃতির সৌন্দর্যের বোধহয় তুলনা মেলে না। অন্তত সেকালে। এর চমৎকার চিত্ররূপ ফুটে উঠেছে ঝিনাইদহ সাজাদপুর পতিসর ঘিরে রবীন্দ্রনাথের লেখায়, বিশেষ করে ‘ছিন্নপ্রতাবলীর’ পাতার পর পাতায়।

 

শারদীয় উৎসব উপলক্ষে ছবির দাক্ষিণ্যে শিক্ষিত হিন্দু পরিবারের সদস্যদের দেখা যেতো রাজধানী কলকাতা থেকে গ্রামে বা ছোট শহরে চলে আসতে। উদ্দেশ্য বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে উৎসব-অনুষ্ঠানের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। রাজধানীতে বা শহরে চলেছে কেনাকাটার ধুম। সেটা অবশ্য এখন আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। সে আনন্দের রেশ গড়িয়ে পড়তো ছায়াভরা গ্রামে সচ্ছল-অসচ্ছল নির্বিশেষে। সাধারণ পরিবারের একটা প্রবণতা ছিল গোটা বছর ধরে এই উৎসব-অনুষ্ঠানের জন্য আর্থিক সঞ্চয়ের। ক্রমে সেটা অভ্যাসে পরিণত অসচ্ছল পরিবারগুলোতে যাতে শারদ উৎসব পালনে ত্রুটি না হয়।

 

শারদীয় পূজার শেষদিন বিজয়ার অনুষ্ঠানে দেখেছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সম্পন্ন পরিবারের ঐতিহ্য ভিন্ন সম্প্রদায়ের, বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের বন্ধুস্থানীয়দের মিষ্টি মিঠাই খাবার আমন্ত্রণ জানাতে। আর তারাও সাজগোজ করেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন। পাল্টা নিমন্ত্রণে রমজানের ঈদে বন্ধুদের স্বাদু ভোজে আপ্যায়ন করতেন। সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবাষ্প প্রগাঢ় ছিল না। সময়টা তখন ইংরেজ শাসনামলের।

 

শহুরে অভিজ্ঞতা ভিন্ন কিছু নয়, বরং কিছুটা বিস্তৃত। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের নদীতে ভাসান, অভিজ্ঞতা বেড়া ভাঙতে শুরু করেছে। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত-পেশাজীবী প্রধান শহর। সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চায় পিছিয়ে নেই। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক প্রভাব শুরু হলেও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতিতে বড়সড় টান পড়েনি, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার রেখা তখনও বড় হয়ে উঠেনি। তবে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে আত্মসচেতনতার ঢেউ উঠতে শুরু করেছে।

 

এমন এক পরিবেশেও শারদীয় দুর্গাপূজায় ঢাকের কাঠি বেশ জোরেই বেজেছে। শারদ প্রকৃতির আকর্ষণীয় রূপে কালোছায়ার প্রকাশ নেই। শহরে পূজামণ্ডপে যথেষ্ট ভিড়। কৌতুহলি কিশোরদের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ায় কোনো বাধা নিষেধ ছিল না। আর বিজয়া দশমীর আমন্ত্রণ রাখতেও কোনো অসুবিধা দেখা দেয়নি। স্কুলের হিন্দু সহপাঠীদের মধ্যে কী আনন্দ-উল্লাস পূজার অনুষ্ঠানাদি নিয়ে। বয়স্করাও পিছিয়ে নেই। গোটা শহরটিতে আনন্দ-উল্লাসের স্বচ্ছ ঢেউ। তাতে যে-কেউ অংশ নিতে পারে। শহর থেকে সামান্য দূরে নদীর ধারে গঞ্জে সরগরম ব্যস্ততা। তাতে বই বিকিকিনিরও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এবং তা মিষ্টি মিঠাইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যায়নি।

 

॥ তিন ॥
বিদ্বেষহীন এমন এক সম্প্রীতির পরিবেশ গোটা দেশেই বেশি দিন টেকেনি মূলত দূষিত রাজনীতির টানে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত রাজধানী ও কোনো কোনো শহরে বা গঞ্জে। আর সেটানে রক্তাক্ত দেশবিভাগ পাকিস্তানের জন্ম বিদ্বেষ বিষে। শাসকদের মতিগতি সুস্থ অসাম্প্রদায়িক নয়, সমাজও একই ধারায়। তবু শারদীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে বড়সড় ব্যাঘাত দেখা যায়নি সেটা ছিল রাজনীতির কূটকৌশল। সংখ্যালঘুদের লোক দেখানো দেখভাল।

 

কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের বাপদাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যাবার প্ররোচনা পাকিস্তানি শাসকপক্ষে যথেষ্টই ছিল। উদ্দেশ্য পূর্ববঙ্গের বাঙালি সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করা, সংস্কৃতিচর্চায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা। কারণ পূজা ও ঈদের আনন্দ-উৎসবের পারস্পরিকতার বাইরে সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গন ছিল উভয় সম্প্রদায়ের মিলনবিন্দু। সেখানেও আঘাত করেছে পাকিস্তানি শাসকবর্গ।

 

অন্যদিকে পয়লা বৈশাখের মতো উৎসব অনুষ্ঠানের চরিত্র ছিল পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক কী গ্রামে কী শহরে। বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ। এতে ছিল তরুণ ও যুব সমাজের বিশেষ আগ্রহ। গ্রামেগঞ্জে পূজা উপলক্ষে মেলার অনুষ্ঠানে সম্প্রদায় ও শেণিনির্বিশেষে সব বাঙালির সানন্দ-অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্য করার মতো। যা পছন্দ ছিল না তখনকার সমাজের রক্ষণশীল শ্রেণির এবং সেই সঙ্গে শাসকদের তো বটেই।

 

তবু যেমনটি আগে বলেছি পূজামণ্ডপে, পূজার অনুষ্ঠানে রিাপত্তার ব্যবস্থা থাকতো। আর উপস্থিত নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তরা মহানন্দে দই ও নানাবিধ মিষ্টির সদব্যবহারে পিছিয়ে থাকতেন না। এর মধ্যে দূর গ্রামেগঞ্জে প্রতিমা ভাঙচুরের বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে দেখা যায়নি তা নয়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে সেকুলার বাংলাদেশেও তা ইতস্তত ঘটতে দেখা গেছে। একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার লড়াই সত্ত্বেও।

 

॥ চার ॥
এর কারণ শুধু রাজনীতির পালাবদলই নয়, সমাজচরিত্রের দূষণও এ অবস্থার জন্য দায়ী। পাশাপাশি এ কথাও ঠিক যে স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকলেও আগের তুলনায় পূজার অনুষ্ঠান সংখ্যা বাড়ছে এবং বেড়ে চলেছে। এ সম্বন্ধে স্বীকৃতি হিন্দু সম্প্রদায়েরই। প্রতিমা শিল্পীদেরও উৎসাহ-আগ্রহ কম নয়। পূজা উদযাপনে সংশ্লিষ্টদের পরিসংখ্যান বলে, ‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পূজার সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূজার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। গত বছর দেশে প্রায় ২৯ হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।’

 

তবে শারদীয় পূজার সর্বজনীন চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে পরিবেশ যে সবসময় নির্দোষ থেকেছে তাও নয়। এখানেই বাংলাদেশি সমাজের দুর্বল হিন্দু। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৯৩ সনে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমীর মিছিলে দুর্বৃত্তদের হামলার কথা। কাগজে বড় বড় করে তা ছাপা হয়েছিল। তা ছাড়া প্রতিবছরই দুর্গাপূজা উপলক্ষে কাগজে পড়ি বিক্ষিপ্ত ভাঙচুরের ঘটনা। আর সেই সামাজিক দুর্বল বিন্দুগুলোর যথাযথ মেরামতের ব্যবস্থা না দেওয়ার ফলে যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য।

 

ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তার অভাব নয়। অভাব সমাজে সুস্থ মূল্যবোধ সঞ্চারের, সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার আগ্রহের অভাব। তাই বছর কয় ধরে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দুর্বৃত্তপনা গোটা বাঙালি সমাজে বিস্তার লাভ করছে, এবং তা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নির্বিশেষে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যেমন আক্রান্ত হচ্ছে ঈদের জামাত তেমনি শিয়া সম্প্রদায়ের আশুরার অনুষ্ঠান। প্রতিমা ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

 

উৎসবের আনন্দ-অনুষ্ঠানে সহিংস আক্রমণ এ যেন এক অচেনা বাংলাদেশ। অবশ্য এ ঘটনাবলীর পেছনে শুধু স্থানীয় রক্ষণশীলতাই নয়, রয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতি ও সন্ত্রাসের প্রভাব। এ দুষ্ট প্রভাব থেকে বাংলাদেশ নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। তাই যেমন পূজার অনুষ্ঠানে তেমনি আশুরায় তেমনি অন্যত্র নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে যা সাত-আট দশক আগে দেখা যায়নি বা যা নেবার প্রয়োজন পড়েনি। সেই সমাজ ততটা অগ্রসর না হলেও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিল। এ কথা মানতেই হয়।

 

তবে স্বস্তির বিষয় প্রশাসনের তরফ থেকে যেভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের দমনের প্রক্রিয়া চলছে তা যথাযথভাবে চালানো হলে ধর্মীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশে হালে পানি পাবে না। তাই সন্ত্রাসীকুলের উচ্ছেদ না ঘটা পর্যন্ত যেন এ প্রক্রিয়া বন্ধন হয়। তবে সুস্থ সমাজ গড়া ও সমাজে সুস্থ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার শ্রমসাধ্য কাজ হাতে না নিলে সন্ত্রাসের বিষঝাড় সমূলে উৎপাদিত হবে না। এ সত্য যেন শাসকদের মনে থাকে। তাহলে অন্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে শারদীয় পূজার অনুষ্ঠানও নির্বিঘ্ন হতে পারবে।

 

লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী

সূত্র:রাইজিংবিডি