রবিবার , ১৪ জুলাই ২০২৪ | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

বগুড়ায় কাঠের পরিবর্তে লোহার তৈরি রথই বিষাদে পরিণত করেছিল!

Paris
জুলাই ১৪, ২০২৪ ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দীপক কুমার সরকার, বগুড়া:

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার প্রচলন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রার শুভ সূচনা হয়। রথযাত্রার দিন দেশের সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে ভক্তগণের সামনে আনা হয়। তারপর সুসজ্জিত রথে বসিয়ে দেবতাদের পুজো সম্পন্নপূর্বক রথ টানা হয়। রথটি ভক্তরা টেনে মূল মন্দির থেকে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ী খ্যাত গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ৯ দিন পর তিন দেবতাকে ওই পক্ষের দশমীতে আবার রথটি টেনে আগের স্থানে আনা হয়। যা উল্টো রথযাত্রা নামে পরিচিত। এ বছর উল্টো রথযাত্রা ১৫ জুলাই সোমবার।

এ বছর ভারতের ন্যায় বাংলাদেশেও বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ ও উৎসাহ-উদ্দিপনা এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে রথযাত্রা উৎসব পালিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বগুড়ায় আনন্দের রথযাত্রায় বৈদ্যুতিকস্পর্শে ৫জনের মৃত্যু ও অন্তত ৪০ জনের আহতদের করুন আকুতি বিষাদে পরিণত হয়। এতে গোটা দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্যদের সম্প্রদায়ের মাঝে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেউ বলছে ‘রথযাত্রার আয়োজক কমিটির দায়িত্ব অবহেলা’ আবার অনেকেই এই দূর্ঘটনা বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতি ্আঘাত হেনে তাচ্ছিল্যতার স্বরুপ দেবতাকেই দায়ি করছেন! তবে যাই হোক বগুড়ার রথযাত্রায় রথের অবকাঠামো তৈরী ও পরিচালনায় আয়োজকদের দুরদৃষ্টিতার অভাব ও অদক্ষতার পরিচায়ক বলে দাবী প্রশাসন ও হিন্দুধর্মীয় একাধিক সংগঠনের।

বগুড়ায় ইসকন পরিচালিত ওই রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হতাহতের ঘটনাটি তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিএম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, নেসকো ও সিভিল সার্জনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করেছে। এ ব্যাপারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, তারা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও আয়োজকদের সাথে কথা বলেছেন, সর্বোপরি যে রথে এই দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অচিরেই তদন্তের প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেয়া হবে।

সরেজমিনে সম্প্রতি দুপুরে সেই দূর্ঘটনায় কবলিত রথটি দেখতে বগুড়ার পুলিশ লাইনস শিব মন্দিরে যাই। মন্দিরের সামনে রাখা রথটি দেখে নানা প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসে।

মন্দিরের সামনে রাখা রথটিতে কোনও ধরনের কাঠ ব্যবহার হয়নি। পুরোটাই লোহার তৈরি। ৩২ ফুট চুঁড়া সম্বলিত উচ্চ রথটিতে হাইড্রোলিক ব্রেক ও চূড়া উঁচু-নিচু করার হাইড্রোলিক গিয়ার আছে। সম্পূর্ণ ধাতব নির্মিত এই রথে রয়েছে মাত্র চারটি চাকা এবং তাও প্রয়োজনীয় মাপে চওড়া নয়। যেভাবে এটি পরিচালনা করা হয়, তা কোনভাবেই নিরাপদ নয়। কারণ চূড়া উঠানো নামানোর যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি ম্যানুয়ালি তৈরি। একটি হুইলের সাথে দু’টি পেনিয়াম যুক্ত করে আয়রন রোপের মাধ্যমে এটি করা হয়।

দেখা গেছে, প্রধান পেনিয়ামের সাথে একটি লক আছে। সবকিছু বিবেচনায় রথ কখনও ধাতব বস্তু বা লোহার তৈরি হতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে এই লকটা শেষ মুূহূর্তে কাজ না করায় চূড়াটি নামতে পারেনি। আর এ কারণে তা ১ কেভি সঞ্চালন লাইনের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুতায়িত হয়ে ফলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

অথচ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী রাজার জন্য রথ নির্মাণের কাঠ সোনার কুঠার দিয়ে কাটা হয়। অক্ষয় তৃতীয় থেকে শুরু হয়ে পুরো দুই মাস ধরে রথ প্রস্তুত করা হয়। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জঙ্গলে গিয়ে গাছ চিহ্নিত করেন। গাছটিকে পূজা করার পর বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সোনার কুঠার দিয়ে কেটে নিয়ে রথ তৈরি করা হয়। একটি ছুতোর পরিবার বংশানুক্রমিক রথযাত্রার জন্য গাছ কাটেন। ওই পরিবারের সদস্য প্রথম সোনার কুঠার জগন্নাথ দেবের পায়ে স্পর্শ করেন। তারপর জগন্নাথের আশীর্বাদ নিয়ে গাছ কাটেন। এই প্রথা এখনও পুরী সহ এদেশেও চলমান। কিন্তু সেই প্রথা ভেঙ্গে বগুড়ার শহরের সেউজগাড়ি এলাকার রথটি কাঠের পরিবর্তে লোহা দিয়ে তৈরি করেছিল সংশ্লিষ্ট ইসকন মন্দিরের দায়িত্বশীলরা।

বগুড়া পুলিশ লাইনস শিব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পরেশ আচার্য্য বলেন, প্রাচীন এ উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ ও কপিলা সংহিতায়। ১৩শ’ শতাব্দী থেকে ইউরোপীয় পর্যটকদের দ্বারা উৎসবের রেকর্ডগুলোতেও এর উল্লেখ আছে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীতে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের এই রথযাত্রার গোটা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আসছে। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে ১০৮ কলসি জল ঢেলে স্নান করানো হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে। এরপর তিনটি রথের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করায় এই উৎসবের সুত্রপাত হয়।

তবে রথগুলোর এর মধ্যে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ বহনকারী রথটি সর্বোচ্চ এবং এর উচ্চতা ৪৪ ফুট ২ ইঞ্চি। বিশেষ কাঠের তৈরি এই রথের রয়েছে ১৬টি চাকা। সোনার কুঠার দিয়ে রথের জন্য কাঠ কাটা হয়। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই বিধি পালন হয়ে আসছে। রথ নির্মাণ করতে কোনও পেরেক বা কাটা কাঠ ব্যবহার করা যায় না। কাঠ হতে হবে সোজা ও খাঁটি। রথ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কারিগররা মন্দির চত্বরেই থাকেন। তাদেরও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও অর্জুন কাঠের তৈরি রথে চড়ে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন। এদিকে রথযাত্রা নিয়ে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি এলাকায় রাস্তার যে অংশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে রাস্তা ২৫ ফুটের বেশি নয়। তা ছাড়া এই রথের উচ্চতা ধাতব শলাকা সংযুক্ত পতাকাস্ট্যান্ডসহ মোট ৪০ ফুট বলে বগুড়া ইসকনের অধ্যক্ষ খরাজিতা ব্রহ্মচারী নিজেই বলেছেন। তবে এই রথের প্রকৃত উচ্চতা ৩২ ফুট বলেও বলা হয় তাদের পক্ষ থেকে।

ভারত-বাংলাদেশের সব জায়গায় কাঠের তৈরি রথ ব্যবহার করা হলেও ইসকনের রথ ধাতব বস্তু দিয়ে তৈরির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন সকলের। কারণ গত বছর ভারতের ত্রিপুরায় ইসকনেরই ধাতব রথে হাইভোল্টেজের তারের সংস্পশ্যে এসে ৭জন মারা গেছে। এর শিক্ষা নিয়ে অন্তত বগুড়ায় বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত ছিল কারণ গত বছর বগুড়া সদর থানার সামনে ইসকনের রথের চূড়ায় বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করলেও ভাগ্যক্রমে তখন বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেনি।

শহরের কাটনারপাড়া নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের সভাপতি চপল কান্তি সাহা বলেন, যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথা ভেঙে সেউজগাড়ি আনন্দ আশ্রমের ইসকন মন্দিরের দায়িত্বশীলরা কেন কাঠের পরিবর্তে লোহা দিয়ে রথ তৈরি করেছেন, ‘রথযাত্রা আয়োজক কমিটির ভুল ও গাফিলতির কারণে মাশুল দিতে হয়েছে আমাদের। দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

সেউজগাড়ি এলাকার বাসিন্দা ওই রথের চালক গোবিন্দ দাস ও শিব পাল জানিয়েছেন, রবিবার বিকাল ৫টার দিকে সেউজগাড়ি ইসকন মন্দির থেকে প্রতি বছরের মতো রথযাত্রা শুরু হয়। প্রায় ১৫ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ রথটির রশি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০-২৫ ফুট উচ্চতায় চূড়ার রডটি ওঠানো হয়েছে। রডের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপরও ভক্তরা রশি টেনে রথটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পুলিশ লাইনস এলাকায় শিব মন্দিরে নিয়ে গেছেন।

বগুড়ার সেউজগাড়িস্থ আনন্দ আশ্রমের ইসকন মন্দিরের সভাপতি দীলিপ কুমার দেব ‘গত ১৮ বছর ধরে লোহার তৈরি রথ ব্যবহার করে আসছি আমরা। সারাদেশে ৩০টির বেশি লোহার রথ আছে। একমাত্র ভারতের পুরীতে এখনও কাঠের রথ ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে লোহার রথ ব্যবহার হচ্ছে। দায়িত্বরতরা বিদ্যুতের তার দেখে চূড়া নামানোর চেষ্টা করলেও হাইড্রোলিক গিয়ার কাজ করেনি। তারা রথ থামাতে চিৎকার করলেও ভক্তরা শোনেননি। ভক্তরা রশি টেনে নিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের তারে লেগে রথের চূড়ায় আগুন ধরে যায়।’ তবে আগামীতে চূড়াটি কাঠের ও উচ্চতা কম করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’

বগুড়া ইসকনের রথযাত্রা আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘অতীতে কখনও এ রকম দুর্ঘটনা ঘটেনি। রথযাত্রার সবকিছু দেখভাল করতে কমিটির পক্ষ থেকে ১০০ জন সেবক নিয়োগ ছিলেন। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যাতে চূড়ার স্পর্শ না লাগে, সেজন্য চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দায়িত্বে থাকা অলোক কুমার ঘটনাস্থলেই মারা যান। সুশান্ত দাসের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন তিনি। ‘দায়িত্বে অবহেলা ছিল না কারও’ সতর্ক ছিলাম তবুও।

তবে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বছরে দুই দফা রথযাত্রা ও উল্টো-রথযাত্রা বের হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান অনুযায়ী ঠিক কত ফুট উচ্চতায় রথ ওঠানো যাবে, তা নিয়ে আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া ওঠানো হয়। চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব ছিল একজনের হাতে। কিন্তু তার ভুলেই ঘটে গেলো মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা। আয়োজকদের ভুলেই এটি ঘটেছে। তাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’ তবে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

হতাহতের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ইসকন মন্দির কমিটির সহসভাপতি ও উত্তরাঞ্চরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ভক্তি বিনয় স্বামী মহারাজ এবং সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারীর নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধি দল বগুড়ায় আসেন। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভক্তদের খোঁজখবর নেন। এ ছাড়া মৃত পাঁচ জনের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে এবং আহতদের ১০-২০ হাজার টাকা করে দেন। একইসঙ্গে আহতদের চিকিৎসা সহায়তার আশ্বাস দেন।

উল্লেখ্য ৭ জলাই রবিবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকার আমতলা মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। আহত অবস্থায় ৩৮ জনকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল ও পাঁচ জনকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আরো গুরুতর আহত ২জনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।

সর্বশেষ - রাজশাহীর খবর