রাজশাহীর ৬ উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন

ফের নেতৃত্বে পুরনোরাই, কোন্দলে পদবঞ্চিতরা 

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আওয়ামী লীগের রাজশাহী জেলার অধিকাংশ উপজেলা সম্মেলনে পুরনো নেতাদের পুনরায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। এতে করে পদবঞ্চিতদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। তারাই দলে প্রকাশ্যে কোন্দল সৃষ্টির চেষ্টা করেছে বলে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এর বহির্প্রকাশ দেখা গেছে দুই-একটি উপজেলায় সম্মেলনস্থলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে প্রকাশ্যে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায়।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল সুসংগঠিত ও ঢেলে সাজাতে তিন মাসের মধ্যে জেলা-উপজেলায় সম্মেলন শেষ করতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে তিনি সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা ও উপজেলার সম্মেলন কমিটি গঠনের বিষয়ে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কবার্তাও দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনার আলোকে গত তিন মাসে রাজশাহী জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৬টিতে এবং মহানগরীর ৫ সাংগঠনিক থানার সব কটিতেই সম্মেলন হয়েছে।

গত ৫ মার্চ পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে দীর্ঘদিন থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলীকে পুুনরায় সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদক মাজদার রহমান সরকারকে হটিয়ে নতুন সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েনউদ্দিনের প্রিয়ভাজন হাফিজুর রহমান হাফিজকে।

প্রায় আট বছর পর গত ৬ মার্চ মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তৃতীয়বারের মতো উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম। আর সাধারণ সম্পাদক হন মোহনপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মফিজউদ্দিন কবিরাজ। সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সভাপতি ও আশরাফুল ইসলাম বাবুল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর আগেও তারা এই দুই পদে আসীন ছিলেন। এই দিন সম্মেলনস্থলে বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাস আলী গ্রুপের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে।

গত ২২ মার্চ পুঠিয়া সরকারি পি এন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামকে পুনরায় সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেককে সরিয়ে দিয়ে খ. ম. শাহরিয়ার রহিম কনককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। অবশ্য গত ২৪ মার্চ দুর্গাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি ও সম্পাদক উভয় পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে দুর্গাপুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ফিরোজকে সভাপতি ও উপজেলার দাউকান্দি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে।

এর আগে ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক সভাপতি ও গোলাম সরোয়ার আবুল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর ৭১ সদস্যের উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য তালিকা করা হয়। এই তালিকায় বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত-শিবিরের অন্তত ১৬ জন জায়গা পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ মতে, বর্তমান সহসভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম হেলাল, আইনবিষয়ক সম্পাদক মো. মাজেদুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রহমান রেজা বিএনপি ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মো. আশরাফুল ইসলাম, ত্রাণ ও সমাজক্যাণ সম্পাদক মো. মাসুদ রানা কামাল, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. ফরহাদ হোসেন মজনু, সহ-প্রচারবিষয়ক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন, সদস্য মো. এসএম এনামুল হক, মো. হাছেন আলী, মো. হাবিবুর রহমান মটর, রেজাউল হক ও মোজাম্মেল হক জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মো. হাফিজুর রহমান ও সদস্য মো. আতাউর রহমান জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে এবং যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আশিকুর রহমান সজল রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে অভিযোগ আছে। পরে এই তালিকা নিয়ে জেলার নেতারা বৈঠকে বসলে তালিকায় বিতর্কিতরা স্থান পাওয়ায় হট্টগোলের এক পর্যায়ে বৈঠক স্থগিত হয় বলে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান। তিনি বলেন, তারপর থেকে এখনো ওই কমিটির অনুমোদন হয়নি।

জানতে চাইলে বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘একসময় বাগমারা বাংলা ভাইয়ের দখলে ছিল। আর বর্তমান এমপির মাধ্যমে বাগমারা এলাকা বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত-শিবির ও রাজাকারদের হাতে বন্দি। ৭১ সদস্যের বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে ১৬ জনই এসব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের মুঠোফোনে একাধিক দিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে রাজশাহী মহানগরীর ৫টি সাংগঠনিক থানার সব কটিতেই সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন হয়েছেন। গত ২৭ মার্চ নগরীর বাটার মোড়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নগরীর বোয়ালিয়া (পূর্ব) থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আতিকুর রহমান কালু, সাধারণ সম্পাদক পদে শ্যামল কুমার ঘোষ, বোয়ালিয়া (পশ্চিম) থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক পদে শামসুজ্জামান রতন এবং রাজপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে হাফিজুর রহমান বাবু ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ আনসারুল হক খিচ্চু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ ছাড়া গত ৩০ মার্চ বিকালে শাহ মখদুম থানার মোড়সংলগ্ন মাঠে সম্মেলনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নগরীর শাহ মখদুম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে সৈয়দ আখতারুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক পদে শাহাদত হোসেন শাহুকে পুনরায় দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। একই দিন দুপুরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নানকে সভাপতি ও মো. আলাউদ্দিনকে পুনরায় মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

মহানগরীর পাঁচ সাংগঠনিক থানার সম্মেলন নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও সম্মেলন হয়ে যাওয়া ৬টি উপজেলার অধিকাংশেই সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি-সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলে কোন্দল বিরাজ করছে। এর মধ্যে বাঘা, বাগমারা, দুর্গাপুর ও মোহনপুরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন অনেকটাই প্রকাশ্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২১ মার্চ বাঘার শাহদৌলা সরকারি কলেজ মাঠে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সমর্থকদের সঙ্গে বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাছ আলীর সমর্থকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ভাঙচুর করা হয় মঞ্চ ও সম্মেলনের চেয়ার। এতে উভয় গ্রুপের অন্তত ২০ জন আহত হয়।

জানতে চাইলে আক্কাছ আলী বলেন, ‘আমিসহ আমার প্রায় ১০ হাজার সমর্থক সম্মেলনস্থলে প্রবেশের চেষ্টা করলে কলেজের প্রধান ফটকেই বাধা দেওয়া হয়। পরে আমরা কলেজের পেছন গেট দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে আমাদের নারীকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়। আমরা জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ক্যাডার বাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালায়। তবে সম্মেলনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে আমি সমর্থকদের নিয়ে চলে আসি।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সমর্থক ও বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল বলেন, দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন- দলে বিশৃঙ্খলাকারীদের জায়গা নেই। সম্মেলনস্থলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অতর্কিতভাবে আক্কাছ ও তার বাহিনী একযোগে প্রবেশের চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সরিয়ে দেয়। পরে শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন শেষ হয়।

এদিকে মোহনপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মফিজউদ্দিন কবিরাজ দলের উপজেলা সভাপতি এবং অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামকে দুর্গাপুর উপজেলায় পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত করায় তৃণমূলে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষরা কীভাবে দলের সভাপতি হতে পারে তা তাদের বোধগম্য নয়।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনীল কুমার সরকার বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই আমরা রাজশাহীর ৬টি উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি- সম্পাদক নির্বাচিত করেছি। ওই সময় কেউ অভিযোগ করেনি। আসলে যারা দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তারা আজীবনই তাই করবে। তারা আসলে দলের আদর্শকে ধারণ কিংবা লালন করে না।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা এসএম কামাল হোসেন বলেন, ‘বাগমারায় কমিটি হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আমি কারও কাছে বিক্রি হইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতেই দলীয় সভানেত্রী জেলা-উপজেলা পর্যায়ে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। আশা করছি, রাজশাহী জেলার যে ৩টি উপজেলায় সম্মেলন বাকি রয়েছে তা মে মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।’

এএইচ/এস