ফেনীর আলোচিত ইয়াসিন হত্যা মামলার পুনঃতদন্তের নির্দেশ

ফেনী সদর উপজেলার আলোকদিয়ার আলোচিত ইয়াসিন হত্যায় খারিজ হওয়া মামলা পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সোমবার জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু নাসের ইউছুফ মোহাম্মদ মোশারফ এ আদেশ দেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্মিলন (বামাস) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নান্টুর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন আদালত।

আলোচিত ইয়াসিন হত্যা খারিজের পর ২০২০ সালে দৈনিক যুগান্তরে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদের ওপর ভিত্তি করে বামাস নিজ উদ্যোগে জেলা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ফেনীর আলোকদিয়া হতে ইয়াসিনের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে ফেনী মডেল থানা পুলিশ। তার মাথা ও পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। ঘটনার পরদিন তার মা হাজেরা বেগম ফেনী জেনারেল হাসপাতালে এসে মরদেহ শনাক্ত করেন। ইয়াসিন খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থানার মধ্যম লামকুপাড়ার মৃত আলী আহাম্মদের ছেলে।

এ সময় ঘটনাস্থল থেকে কালো রঙের ছুরির কাভার, দুটি সিমযুক্ত মোবাইল ফোন, ১৫টি চাবি, একটি মানিব্যাগ, মানিব্যাগের ভেতর দুটি সিম ও ছয়টি মোবাইল নাম্বার লেখা টুকরো কাগজসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করে পুলিশ।

এসআই সুমন চন্দ্র নাথ এ মামলায় সাক্ষী গিয়াস উদ্দিন, নাসির উদ্দিন, মো. রফিক, মো. আবুল হোসেন, ফাতেমা আক্তার বানু, হাসান ইকবাল প্রকাশ শাহিন, আবু বকর সিদ্দীককে মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের দেওয়া জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন।

মো. রফিক, আবুল হোসেন, ফাতেমা আক্তার বানু, ইউপি সদস্য হাসান ইকবাল প্রকাশ শাহিন, আবু বকর সিদ্দীক ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দি প্রদান করেন। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামি সরোয়ার হোসেন সোহেল ও তার বাবা হাজি আবুল মিয়া প্রকাশ আবুল কোম্পানিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হাজি আবুল মিয়া প্রকাশ আবুল কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আসামি সরোয়ার হোসেন সোহেল যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য বিশেষ পুলিশ সুপার, ইমিগ্রেশন, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ঢাকা, বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন), শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম ও ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সিলেট, বিশেষ পুলিশ সুপার ইমিগ্রেশন (ল্যান্ড অ্যান্ড সি-পোর্ট) আবেদন করেন। পরে সোহেলকে ফেনী মডেল থানা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়।

এতে সরোয়ার হোসেন সোহেল বিদেশে পালিয়ে যায়। এসআই সুমন চন্দ্র নাথ নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে আইন প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হওয়ায় তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান পিপিএমকে। তিনি নিহত ইয়াসিনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখেন আঘাতজনিত কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। এ মামলার কিছুটা অগ্রগতি হলে পরবর্তীতে পরশুরাম মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে মো. মাহবুবুর রহমান পিপিএমকে বদলি করা হয়। পরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফেনী মডেল থানা পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ আলীকে।

কোনো কারণ ছাড়াই পরিদর্শক মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে মামলাটি নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও বর্তমানে সোনাগাজী থানার ওসি মো. সাজেদুল ইসলামকে।

পুলিশ পরিদর্শক মো. সাজেদুল ইসলাম শনাক্ত ও খুনি না ধরে এবং খুনের বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে এক মাসের মধ্যে একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদান দেন। পরে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন। পরে ফেনীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবদুর রহিম মামলাটি খারিজ করে দেন। জব্দকৃত আলামত বিধি মোতাবেক নিষ্পত্তির জন্য ফেনী মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আদালত।

মামলার বাদী হাজেরা বেগম জানান, এসআই সুমন নাথ খুনের ঘটনায় সরোয়ার হোসেন সোহেল ও তার বাবা হাজি আবুল মিয়া প্রকাশ আবুল কোম্পানিকে সন্দেহ করেছিলেন। পুলিশ পরিদর্শক মো. সাজেদুল ইসলাম সরোয়ার হোসেন সোহেল ও তার বাবা হাজি আবুল মিয়া প্রকাশ আবুল কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আসামি না করে দ্রুত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।

ফেনীর সিনিয়র আইনজীবী অ্যডভোকেট গিয়াস উদ্দিন নান্নু ও বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠনের (বামাস) সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম নান্টু ও অ্যডভোকেট মানিক চন্দ্র শর্ম্মা যুগান্তরকে জানান, খুনের ঘটনায় প্রকৃত তথ্য গোপন করে আসামিদের রক্ষা করতে পুলিশ একটি দায়সারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। আদালত পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। চাঞ্চল্যকর লোমহর্ষক এ হত্যা মামলাটি কোনোভাবেই খারিজ হতে পারে না। হত্যাকাণ্ড ও হত্যাকারীদের বাঁচানোর অপচেষ্টার ঘটনা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া জরুরি।
 

সূত্রঃ যুগান্তর