প্রেরণার বাতিঘর রাবির ‘সাবাস বাংলাদেশ’

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি

পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারদের ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে মুক্ত করা ছিল বাঙালিদের পরম লক্ষ্য। দেশমাতৃকার টানে ধর্ম-বর্ণ-তরুণ-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। উৎসর্গীত হয়েছে লাখো বাঙালির প্রাণ। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালির দৃঢ়তার কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী আর দেশিয় রাজাকারদের ঔদ্ধত চরিত্র। তাই তো পৃথিবী আজ অবাক তাকিয়ে দুর্বিনীত বাঙালির প্রতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্যটি ঠিক যেন বাঙালির এই মনোবল, দৃঢ়তা আর সাহসিকতারই একটি প্রতিচ্ছবি।

’৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই আন্দোলনে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। এরপর ’৭১ সালের ২৫মার্চ পাকিস্তানিরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিশ্চিহ্ন করার যে ব্যর্থ প্রয়াসের সূচনা করে তাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও আক্রান্ত হয়। কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে দল রাজশাহীতে সক্রিয় ছিল তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিপুল অংশ শহরে প্রবেশ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের বিতাড়িত করতে গিয়ে শাহাদৎ বরণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, অধ্যাপক মীর আবদুল কাউয়ুম, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই। তাঁদের আত্মত্যাগ ও স্মৃতির প্রতি সম্মানে নির্মাণ করা হয় এই ভাস্কর্যটি।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মিত এমন ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাস্কর্য এই ‘সাবাস বাংলাদেশ’। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পশ্চিম পাশের মাঠে ভাস্কর্যটি অবস্থিত। শিল্পী নিতুন কুন্ডের শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় নান্দনিক এই ভাস্কর্যটি গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ’৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

ভাস্কর্যটি ৪০ বর্গফুট জায়গার উপর নির্মিত। ভাস্কর্যের পাদদেশে রয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। ভাস্কর্যটিতে রয়েছে দু’জন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। বয়সে যাঁরা তরুণ। তাঁরা শত্রুকে শেষ করে দিতে অদম্য গতিতে ছুটে চলেছেন। একজনের পরনে প্যান্ট, অন্যজনের লুঙ্গি। যা মুক্তিযুদ্ধে সকল পেশার মানুষের অংশগ্রহণের প্রতীক। একজন দু’হাত দিয়ে রাইফেল ধরে আছেন, পাশেরজনের ডান হাতে রাইফেল আর বাম হাত মাথার উপরে মুষ্টিবদ্ধ। তা যেন বাঙালির হৃদয়ের বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ।

ভাস্কর্যের ঠিক পেছনেই রয়েছে ৩৬ ফুট লম্বা একটি দেয়াল। দেয়ালটির উপরিভাগে একটি বৃত্ত, যা স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক। ভাস্কর্যটির দু’পাশে রয়েছে আয়তাকার দু’টি দেয়াল। যার একটিতে কয়েকজন বাউল গান করছেন। যা বাঙালি জাতির গ্রামিন সংস্কৃতির পরিচায়ক। অপর দেয়ালটিতে মায়ের কোলে শিশু ও দুই তরুণী, যাদের একজনের হাতে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সেই পতাকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক কিশোর। শিল্পী নিতুন কুণ্ডের শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় কালজয়ী এই লাল বেলে মাটির ভাস্কর্যে গ্রথিত হয়ে আছে সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলার চূড়ান্ত এক বিজয়ের জীবন্ত চিত্র। যা আজ বাঙালিদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে গৌরবের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর্যের নিম্নভাগে লেখা রয়েছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত চরণ, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’।

তৎকালীন ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটির সদস্য আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ। তাঁর প্রশাসন, ছাত্র সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি জনসাধারণের অংশগ্রহণও ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাঁরাও ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য চাঁদা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মো. হেলাল উদ্দিন দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম করে আসছেন। ভাস্কর্যটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক তরুণ আত্মোৎসর্গ করেছেন। তাঁদের স্মরণে নির্মিত এই ভাস্কর্যটি আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে বাঙালি জাতির দেশপ্রেম পরস্পরের সম্প্রীতি ও একতাবদ্ধতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। দেশভাগের পর থেকে সংগঠিত সকল সংগ্রামেই এদেশের তরুণেরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এ জাতি কখনোই মাথা নোয়াবার নয়।

স/আর