প্রাণিসম্পদ খাত উন্নয়নে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

করোনা মহামারির মধ্যে অন্যান্য খাতের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাণিসম্পদ, ডেইরি এবং মৎস্য খাত। সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থায়ও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তবে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সেই ক্ষতি অনেকটা কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রাণিসম্পদ, ডেইরি এবং মৎস্য খাত উন্নয়নে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাটির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও। ফলে বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। এর বাইরে ‘সমষ্টি’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় পশুপালন, মৎস্য ও ডেইরি খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব রাখছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ। তবে এই খাতটির উন্নয়নে অংশীদারিত্ব সৃষ্টি ছাড়াও আরো সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠ-কেয়ার বাংলাদেশ আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এসব মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক আমানুর রহমানের সঞ্চালনায় ‘মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুর্নগঠন ও প্রাণিসম্পদ খাত পুনরুদ্ধার’ বিষয়ে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

কেয়ার বাংলাদেশের তথ্যমতে, পশুপালন, কৃষি এবং সামাজিক সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে দেশের দরিদ্র, অনগ্রসর এবং সংখ্যালঘু পরিবারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘সমষ্টি’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের চারটি অঞ্চলের মোট ১৪টি জেলার ২৮টি উপজেলার এক লাখ ৮০ হাজার পরিবারে আয় বৃদ্ধি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় গরু মোটাতাজাকরণ, ডেইরি ও হাঁস পালন, চিংড়ি, শাকসবজি এবং ফল চাষে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের। এছাড়া এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরি এবং সামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করতেও কাজ চলমান রয়েছে। প্রাণী ও ডেইরি পণ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বিপণন নিশ্চিত করতে এই প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে নারীদের জন্য ১০টি মার্কেট স্থাপন করেছে কেয়ার বাংলাদেশ। এর বাইরে স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সঞ্চয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি। করোনাভাইরাসের মধ্যে প্রান্তিক মানুষদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে ‘সমষ্টি’ প্রকল্পের আওতায়। যার মধ্যে রয়েছে রংপুর অঞ্চলের দুই হাজার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রংপুরের ছয় উপজেলার পাঁচ হাজার পরিবারকে সাড়ে চার হাজার টাকা নগদ অনুদান এবং আরো দুই হাজার ৮০০ কৃষক এবং পাঁচ হাজার ২০০ অসহায় পরিবারকে সহযোগিতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সমষ্টি প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের সুবিধাভোগী পাঁচ লাখের বেশি পরিবার প্রাণিজ ও ডেইরি খাতের পণ্য বিপণনের সেবা উন্নত করতে পেরেছেন যাদের অর্ধেকেই নারী। দুই লাখ ২০ হাজারের বেশি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং পরিবারগুলোর প্রায় ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অতিরিক্ত অর্থ আয় হয়েছে। ৪০৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ২৮ হাজার পরিবার সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। প্রাণি ও ডেইরি খাতের পণ্যের বিপণন সহজতর করতে ১০টি বেসরকারি কম্পানি এবং তিনটি সরকারি দপ্তরের সঙ্গে ইতিমধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সাড়ে তিন হাজারের বেশি সুবিধাভোগীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ২০০ নারী।

স্বাগত বক্তব্যে কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে প্রাণিসম্পদ ও কৃষি খাতকে উন্নত করতে এবং দারিদ্র দূরীকরণে নানা চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, একটি পরিবার কয়েকটি হাঁস-মুরগি বা গবাদি পশু পালন এবং মাছ চাষের মাধ্যমে একটু বাড়তি আয় করার চেষ্টা করছে। একাধারে এটি যেমন তার নিজস্ব আয়ের উৎস, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। গত ১০ বছরে গরুর খামার, ছাগলের খামারের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এই খাতটির পরিচর্যা খুব জরুরি। এ জায়গাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য কেয়ার যেভাবে সচেতন, এগুলো নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের এগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। বিশেষ করে সরকারের একটি বড় ভূমিকা এখানে আমরা আশা করি।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আব্দুল জব্বার শিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মাংসে স্বয়ংসম্পর্ণ। এখন আর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। এই অবস্থায় আসতে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভিন্ন এনজিওসহ সকলের সহযোগিতা রয়েছে। আমাদের দেশে এ বছর দুধ উৎপাদন ১০৬ কোটি মেট্রিক টন। ডিম হয়েছে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি। যেটা স্বাধীনতার পর পর ছিল মাত্র ১১৫ কোটি। সুতরাং এ খাতে সরকারের সু-দৃষ্টি আছে বলেই এত উন্নতি এসেছে। বেসরকারি সেক্টরের যারা এ খাতের সঙ্গে যুক্ত, তারাও কাজ করে যাচ্ছে। এখন দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজ এ খাতে জড়িত হচ্ছে, আশা করছি সামনে এ খাতে আরো উন্নতি আসবে।’

বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার সোহেল ইবনে আলী বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড সরকার প্রায় ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে। আজকের এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হতে পেরে আমরা গর্বিত। আমাদের এ সম্পৃক্ততা ভবিষ্যতেও রাখতে চাই। নানা ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও করোনা মহামারির কারণে প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ খাতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ খাতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বা যে মাত্রায় এখাতের উন্নয়ন হচ্ছিল, সে মাত্রা ধরে রাখতে বড় ধরনের সরকারি তহবিলের প্রয়োজন।’

কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রমেশ সিং বলেন, ‘করোনা মহামারি এখনো শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ করোনার দ্বিতীয় ধাপ (সেকেন্ড ওয়েভ) মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশও করোনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এবং এই মহামারি মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। কিছুদিন পর এই মহামারি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু এই মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য এখন ই কার্যক্রম শুরু করা উচিত। এই মহামারির ফলে আমরা শহর ও গ্রাম অঞ্চলের উন্নয়ন ভারসাম্য ও পারস্পরিক নির্ভরতার গুরুত্ব দেখেছি। মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাত  গ্রামীণ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে ও গ্রামীণ উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘করোনার কারণে ই-কমার্স খাতে একটি বড় ফোকাস এসেছে। আমাদের ইক্যাবের ১২০০ সদস্যের মধ্যে ৮৫ ভাগই ছিলো ফ্যাশন, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিক পণ্যসহ অন্যান্য খাতের প্রতিষ্ঠান। প্রথমদিকে মোট আট শতাংশ প্রতিষ্ঠান নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করছিল। কিন্তু করোনার ফলে চলতি বছরের আগস্টে এসে সেই সংখ্যা ২২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত প্রায় আট হাজার কোটি টাকার। এটি (মৎস ও প্রাণি সম্পদ) একটি বিশাল বড় সম্ভাবনাময় খাত। গত কোরবানির ঈদের সময় ডিজিটাল হাট থেকে প্রায় ২৭ হাজার গরু বেচাকেনা হয়েছে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্পের’ প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক ড. মো. গোলাম রাব্বানী, ‘আমাদের দেশে মানুষ যেমন বাড়ছে, ঠিক পশুও বাড়ছে। ১৮ কোটি লোকের জন্য এক কোটির বেশি দুধের গাভী ও দুই কোটির বেশি গবাদি পশুর প্রয়োজন নেই। একটি গবাদিপশু থেকে এক হাজার কেজি মাংস পাওয়া গেলে  ১০০ কেজি ওজনের ১০টি পশু পালনের দরকার নেই। একইভাবে এক গাভী থেকে ৪০ লিটার দুধ পাওয়া গেলে, পাঁচ লিটারের ৮টি গাভী পালনের প্রয়োজন নেই।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিপুষ্টি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘খামারিরা মনে করে দুধের দাম বাড়িয়ে দিলেই তাদের সকল সমস্যা সমাধান হবে। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। আমরা রিসার্চ করে দেখেছি সে দুধের দাম বাড়ানো মাধ্যমে কোনো সমাধান হয় না। সামাধান হচ্ছে নিজেদের মধ্যে এবং সকল অংশীজনদের সমন্বয়ের মাধ্যমে। দুধের উৎপাদন খরচ আমাদের দেশে অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। দুধের দামও ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। যেটা আমাদের জন্য বড় পীরাদায়ক।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. এবিএম খালিদুজ্জামান বলেন, ‘করোনার সময় বহু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পেয়েছিলাম আমরা। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিয়ে প্রস্তুত ছিল সরকার। সরকারের পদক্ষেপের কারণেই লকডাউনের মধ্যেও আমাদের এই সেক্টরের ক্ষতি কমাতে সক্ষম হয়েছি।’

ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহনাজ আক্তার শাহীন বলেন, ‘অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে ব্যাংকের ভূমিকা অপরিসীম তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেই কাজটি ধরে রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের কৃষকের কাছে কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। সে জায়গায় আমরা (ব্যাংকিং সেক্টর) কতটুকু করতে পারছি সেটি একটি বড় প্রশ্ন। নেটওয়ার্ক সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা (ব্যাংকিং সেক্টর) সবাই সে জায়গায় যেতে পারছি না। ব্যাংক এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে।’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ