প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তৎপর বিএনপি

কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে বিএনপি। প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীনে পাঠানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে দলটি।

৩ নভেম্বর ভোটের পর বিশ্বের প্রভাবশালী এই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে চেষ্টা করা হবে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কোনো একটি দেশের প্রতি নির্ভরশীল হতে চায় না বিএনপি। এই মুহূর্তে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ভারসাম্য’র নীতিকেই জোর দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।

কূটনৈতিক উইংয়ের বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা  বলেন, বিগত কয়েক বছর প্রভাবশালী দেশগুলোকে আস্থায় আনতে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। সরকারে গেলে দলটির পররাষ্ট্রনীতি কী হবে, তা ওইসব দেশগুলোকে বোঝাতে পারেননি নীতিনির্ধারকরা। এ ব্যাপারে দোদুল্যমান থাকায় কোনো দেশই বিএনপির প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। যার প্রভাব বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে।

ওই নির্বাচনে বিএনপির সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত চীনও দলটির ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। জামায়াতসহ কয়েকটি ইস্যুতে মোদি সরকার বিএনপির প্রতি ভরসা করতে পারেনি। তাই নির্বাচনের শেষমুহূর্তে বিএনপির কাছ থেকে সরে যায় দেশটি।

এমনকি ভোটের পরও বন্ধুদেশগুলো নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে জোরালো কোনো অবস্থান নেয়নি। উল্টো নির্বাচনের পর প্রায় সব দেশেই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়। নির্বাচনে অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও শুধু কূটনৈতিক সম্পর্কের দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতারা।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  বলেন, এই মুহূর্তে আমরা দুটি বিষয় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রথমত, দল পুনর্গঠন। দ্বিতীয়ত, বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার। করোনার কারণে আমাদের কাজে কিছুটা স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করব। এ লক্ষ্যে আমরা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় জড়িত। তাই ওই দেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের আগ্রহ থাকাটা স্বাভাবিক।

সূত্র জানায়, গত জাতীয় নির্বাচনের পর প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নেয়া হয় বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীর কারণে তা স্থগিত করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে তীক্ষè নজর রাখছে দলটি।

নির্বাচনের ফলাফলের পরই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রটা অনেক সহজ হবে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, ডেমোক্রেটিক পার্টির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে; যা সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক হবে। তাই দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মীর প্রত্যাশা জো বাইডেনের বিজয়।

বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারে তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়; যা দীর্ঘদিন বহাল ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সরকারের নেয়া কিছু উদ্যোগে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। এরপর নানা উদ্যোগ নিলেও সম্পর্ক আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি দলটি। অতীতের বৈরিতা দূর করতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।

নানা মাধ্যমে তৎপরতার পর চীন বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে রাজি হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেশটি কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতাকে নিয়ে আপত্তি রয়েছে দেশটির। তাদের সঙ্গে বসতে না চাওয়ার কথাও বিএনপির হাইকমান্ডকে অবহিত করেছে বেইজিং। চীনের এমন শর্তে বিপাকে পড়ে দলটি।

দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন সিনিয়র নেতার সংখ্যাও হাতে গোনা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক নেতা লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু মাহবুবুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করায় তাকে কাজে লাগাতে পারছে না। এ ছাড়া কূটনৈতিক উইংয়ের বেশিরভাগ সদস্যই নবীন। তাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও ততটা গভীর নয়।

এমন পরিস্থিতিতে দলের সিনিয়র এক নেতাকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়ার চিন্তা চলছে। ওই নেতা সম্মতি দিলে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের সঙ্গে বৈঠক করার উদ্যোগ নেবে হাইকমান্ড। বৈঠক ইতিবাচক হলে চীনে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে বিএনপি।

এদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নেয়া হলেও ভারতকে হাতছাড়া করতে চায় না বিএনপি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। এ ক্ষেত্রে দলটি পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভরশীলও হতে চাচ্ছে না।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত সরকার যাতে কোনো একটি বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন না দেয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সূত্র জানায়, প্রভাবশালী এ তিন দেশ ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যসহ শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য ও দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নানা অনিয়মের বিষয়টি বাংলাদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকদের আমরা অবহিত করেছি। তারা নিজেরাও নানা মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত হয়েছেন। একতরফা নির্বাচন হয়েছে বলে আমরা যে দাবি করে আসছি, সে ব্যাপারে তাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমরা দুটি বিষয় সামনে রেখে এগোচ্ছি। দল গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। আমরা দলীয়ভাবে যদি সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে না পারি, তবে বিদেশিরা আমাদের কিছুই করে দেবে না। রাজনৈতিকভাবে আমরা শক্তিশালী হলে তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।

 

সূত্রঃ যুগান্তর