পুতিনকে করা সেই ফোনালাপই কাল হলো সৌদি যুবরাজের

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যুবরাজ বিন সালমান যে সফল হবেন না তার উদাহরণ পাওয়া গেছে কয়েকদিন আগেই। গত মাসে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক-এর সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করেন বিন সালমান। ওই ঝড়ো ফোনালাপ বেশ তিক্তই ছিল বলা চলে। এরপর থেকেই বিশ্বের দুই শীর্ষ তেল রফতানিকারক দেশ সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে তেলের দাম নিয়ে ভয়াবহ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম মিডল ইস্ট আই। আলোচিত ওই প্রতিবেদনটি লিখেন সংবাদ মাধ্যমটির সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট। তিনি বৃটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রধান বৈদেশিক লেখক ছিলেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুতিনের সঙ্গে সৌদি যুব সেই ফোনালাপ যে কত বড় ভুল ছিল তা আজ মোহাম্মদ বিন সালমান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কারণ, এরপরই দুই দেশ প্রতিযোগিতা করে একে অপরকে টেক্কা দিতে তেলের দাম কমাতে শুরু করে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে ব্যাপকভাবে। তেল সংরক্ষণাগারে জায়গা ফুরিয়ে আসছে। তেল কোম্পানিগুলো উত্তোলন সীমিত করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

তেল ও গ্যাস খাত সৌদি আরবের জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ ও রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশ। তেলের দামের এমন ভয়াবহ দরপতনের ফলে এসব আয় যেন স্রেফ বাতাসে মিইয়ে গেছে।

পুতিনকে চেনেন এমন যে কেউই আপনাকে বলবেন যে, আপনি তার সঙ্গে যত খুশি দরকষাকষি করতে চান, করতে পারবেন। এমনকি আঞ্চলিক যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হলেও তার খুব আপত্তি নেই; আপনি কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো সম্পর্ক তার সঙ্গে রাখতে পারবেন। সিরিয়া ও লিবিয়ায় প্রতিপক্ষ হয়েও তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে পুতিনের অম্লমধুর সম্পর্ক কিন্তু টিকে আছে। কিন্তু আপনি পুতিনকে ব্যাকফুটে ফেলার চেষ্টা করতে পারবেন না। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ঠিক তাই করার চেষ্টা করেছেন।

সৌদি যুবরাজ বিন সালমান দুঃসাহস দেখিয়েছেন পুতিনকে আলটিমেটাম দেয়ার। এমনকি চড়া সুরে কথা বলেছেন। আর বিপরীতে পুতিন এই তেলের দামের দরপতন ঘটিয়ে তার জবাব দিয়েছেন। পুতিন জানেন যে, রাশিয়ার আয়ের উৎসে এক ধরণের ভারসাম্য আছে। ফলে এই জুয়া খেলার সামর্থ্য তিনি রাখেন। কিন্তু তেলের ওপর অতি নির্ভরশীল সৌদি আরবের সেই বিলাসিতা সাজে না।

সৌদি যুবরাজ বিন সালমান এখন বুঝতে পারছেন এই জুয়া খেলায় তার কার্ডগুলো কত দুর্বল। পুতিনকে ফোন করার আগে এমবিএস এমন একজনের পরামর্শ নিয়েছেন যিনি তার মতোই অহংকারি আর হঠকারি। তিনি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্য উপদেষ্টা জেয়ার্ড কুশনার। জেয়ার্ড কুশনারকে যখন এমবিএস আগেভাগে জানিয়ে রাখেন তেলের দাম কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা, তখন কুশনার শুধু শুনেছেন, কোনো আপত্তি জানাননি।

এ কারণেই বোঝা যায় যে, তেলের দাম পড়ার খবর শুনে ট্রাম্প কেন প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিলেন? ট্রাম্প ভেবেছিলেন যে, তেলের দাম যদি ১ সেন্টও কমে, তাহলে অন্য খাতে মানুষের ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়বে ১ বিলিয়ন ডলার বেশি! কিন্তু তিনি যখন দেখতে পেলেন দরপতনের কারণে আমেরিকার নিজস্ব তেল শিল্প পথে বসার উপক্রম, তখন তিনিও বিরোধীতা করতে শুরু করেছেন।

অপরিশোধিত তেলের দাম এখন ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারেরও কম। ফলে এমবিএস শিগগিরই বুঝতে পারবেন যে, দুনিয়ার যখন তার তেল আর প্রয়োজন হবে না, তখন কী হবে! একসময় এই প্রশ্ন করা হলেই পাত্তা দিতেন না সৌদি নেতারা। কিন্তু সেই দিন আর নেই। সৌদি আরবের ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা এখন বেশ প্রবল!

সৌদি আরবের আর্থিক এই দুর্দশা একদিনে হয়নি। ২০১৫ সালে যখন বাদশাহ সালমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭৩২০০ কোটি ডলার। আর গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ সেই অঙ্ক কমে দাঁড়িয়েছে ৪৯০০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২৩৩০০ কোটি ডলার চার বছরে গায়েব হয়ে গেছে।

দেশের মাথাপিছু আয়ও কমেছে। ২০১২ সালে মানুষের আয় ছিল মাথাপিছু ২৫২৪৩ ডলার। আর ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৩৩৩৪ ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, সৌদি আরবের প্রকৃত ঋণের পরিমাণ এ বছর জিডিপির ১৯ শতাংশে দাঁড়াবে। আগামী বছর হবে জিডিপির ২৭ শতাংশ! আর করোনাভাইরাস আর তেল সংকটের কারণে ২০২২ সালে ঋণ হবে সৌদি আরবের জিডিপির ৫০ শতাংশ!

এসবের কারণ কী? অগণিত। ইয়েমেন যুদ্ধ, মিশরের অভ্যুত্থান, আরব বিশ্বে অজস্র হস্তক্ষেপ, আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল অংকের সমরাস্ত্র ক্রয়, নিওমে ভবিষ্যৎমুখী শহর নির্মানের মতো পোষ্য প্রকল্প ছাড়াও, এমবিএস-এর ৩টি অত্যন্ত বিলাসবহুল ইয়াট, পেইন্টিং, প্রাসাদ—এসবের প্রত্যেকটিই সৌদি রাজকোষকে একটু একটু করে সঙ্কোচিত করেছে।

করোনাভাইরাস আসার আগ থেকেই সৌদি আরবের অর্থনীতি পর্যদুস্ত অবস্থায় ছিল। প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৩ শতাংশ। ২০১৭ সালের পর নির্মান খাত হ্রাস পেয়েছে ২৫ শতাংশ। এবার করোনাভাইরাস জনিত লকডাউন যোগ করুন। হজ ও উমরাহও বাতিল করা হয়েছে। হজ ও উমরাহ পালন করতে বছরে ১ কোটি মানুষ সৌদি আরব সফর করতেন। ফলে এই খাতে ৮০০ কোটি ডলার আয় হতো দেশটির। এবার তা-ও হবে না।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স যেখানে টাকা খরচ করেছেন, সেটাই যে শুধু সমস্যা সৃষ্টি করেছে তা নয়। তিনি যেসব খাতে বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোও ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হোটেল রিকুইজিশন করছে হাসপাতাল হিসেবে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বদলে স্রেফ হোটেল মালিকদের পরিচালনা ব্যয় দিচ্ছে সরকার।

সৌদি বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক মিশরীয় ডাক্তারের বেতন ভাতা কমে গেছে। যারা বার্ষিক ছুটিতে গেছেন তাদেরকে টাকাই দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে অনেক ডাক্তারকে বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে। যারা বাসায় থাকবেন, তাদের সেই সময়টুকু হয় বার্ষিক ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে, অথবা বেতনহীন থাকতে হচ্ছে!

এ কারণেই ব্লুমবার্গ প্রতিবেদন করেছিল যে, সৌদি আরবের ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কখন ঘটবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।

আইএমএফ হিসাব করে দেখিয়েছে যে, তেলের দাম ৫০-৫৫ ডলারে নেমে গেলে, সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক রিজার্ভ ২০২৪ সালের ৫ মাসের আমদানি ব্যায়ের সমান হয়ে যাবে। আর এখন তেলের দাম প্রায় শূন্যের কাছে। তার মানে একসময় যা চিন্তাও করা যেত না, সেদিকেই যাচ্ছে পরিস্থিতি।