পথ হারানো জীবনটা আবার চলুক জীবনের গতিতে

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কৌতুক কি জানেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কৌতুক হলো কেউ বোঝার আগে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষেরা তেমনটাই করেছেন। কারণ তারা জানতেন মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য বলে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সমরেশ মজুমদার বলতেন ‌‘মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’। মৃত্যু নিয়ে মুনীর চৌধুরী বলতেন ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’।

জীবনটা যত না সত্য তার থেকেও সত্য মানুষের মৃত্যু। যদিও অনেকে মৃত্যুকে জীবনের একটি অংশ হিসেবে দেখেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো যারা কৌতুক করে মানুষকে হাসায়, তারা সারাজীবন নিজেরা কাঁদে। নীরবে, নিভৃতে। সেটা তারা অন্যদের বুঝতে দেয় না। কারণ তারা জানে যে কৌতুকটা তারা করছে সেটা তাদের জীবনের ভিতরটাকে কত গভীরভাবে আঘাত করছে। ক্ষত-বিক্ষত করছে। পৃথিবীর মানুষ সে খবর রাখে না। তারা কৌতুকের মানুষটাকে দেখে। কৌতুক দেখে পুলকিত হয়। আমোদিত হয়। কিন্তু উল্টোপিঠের বাস্তবতাটা কখনো ভেজা কাপড়ের মতো নিংড়ে দেখে না। কৌতুক করতে করতে চার্লি চ্যাপলিনের অনুভুতিটা ছিল এমন ‘আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হল আয়না, কারণ আমি যখন কাঁদি তখন সে হাসে না।’

জীবনটা হয়তো তাই একটা কৌতুক। যেটা একটা বোবা আয়না দেখে, মানুষ দেখে না। যেটার খোঁজ সবাই পায় না। আয়নাটা অদ্ভুত যে নিজে একটা জড় পদার্থ কিন্তু তার ভিতরে মানুষের মতো জীবদের দেখার একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়। অথচ মানুষ জানে না আয়নার ভিতরে যাকে দেখা যাচ্ছে সে মানুষটা সে নিজে কিনা। কারণ মানুষ কোথাও কোথাও খুব অসহায় হয়। যেমন নিজের মুখটা মানুষ নিজে দেখতে পারে না। সে মুখটাতে আলো না অন্ধকার আছে তা যাচাই করার শক্তি মানুষের ভিতর থাকে না। আলোর কথা বলতেই জাপানি একটা মিথোলজির কথা মনে পড়লো। সেখানে আছে, একদিন খুব ভোরে সূর্যদেবতা কি এক অজ্ঞাত কারণে রেগে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ের গুহায় ঢুকে পড়লেন। অদ্ভুত এক আধার পৃথিবীতে নেমে এলো এর ফলশ্রুতিতে। প্রকৃতি নড়েচড়ে বসলো। প্রকৃতির বুকে যত উদ্ভিদ আর প্রাণী আছে তারাও গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ অন্ধকার পৃথিবীকে পিছনে ঢেলে দেয়। আলো উন্মাদনা পৃথিবীকে এগিয়ে যাবার পথ দেখায়। প্রকৃতিতে যাদের বিচরণ তারা নানাভাবে সূর্যদেবতার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে গুহার সামনে একটা চকচকে রূপোর আয়না ধরা হলো। রুপোর আয়নায় নিজের কদাকার আর রাগান্বিত মুখখানা দেখে সূর্যদেব নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এই মুখটি তার। ভালোভাবে নিজেকে দেখার জন্য আস্তে-আস্তে গুহার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন সূর্যদেব। আর যখন  বেরিয়ে আসলেন ঠিক তখন গুহার মুখ সবাই মিলে পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিলে। সূর্যদেব আর ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। সেই থেকে সূর্য জাপানের আকাশে আজও জেগে আছে।

 

ইংরেজ কবি ও লেখক জিওফ্রে চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’ গল্পমালায় আছে টারটারির রাজা কাম্বুস্কানের কাছে বিস্ময়কর একটা আয়না ছিল, সেই আয়না দেখে তিনি আগে থেকেই বলে দিতে পারতেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

পৃথিবীতে এখন এক গভীর সংকট। এখন একটা জাদুর আয়না যে খুব দরকার যে আয়নার দিকে তাকিয়ে কেউ মানুষদের দেখিয়ে দেবে করোনা থেকে মুক্তির পথ, জীবনের পথ। যে সংকট গ্রাস করেছে সারা পৃথিবীকে সেই সংকটের সামনে আয়নাকে রেখে সংকটকে বুঝানো যেতে পারে আয়নায় ভিতরে সংকটের আলো ঝলমল মুখটা নেই, সেখানে আছে অন্ধকারে মানুষের পথ হারানোর আর্তনাদ। না, আমি কৌতুক করছি না। জীবনের কৌতুকের অচলায়তন ভেঙে নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে চাচ্ছি, যে স্বপ্ন ভাইরাসের মতো একটা মরণঘাতী অস্ত্রের সাথে লড়ে জয়ী হবে। তখন মানুষের জীবনের জয়গানে মেতে উঠবে পৃথিবী আবার। সে আনন্দে মেতে উঠার দিনটিতে পৃথিবীর মানুষেরা পরমাণু অস্ত্রের মতো মরণঘাতী শক্তির পিছনে কোটি কোটি ডলার খরচ না করে ক্ষুধার্ত মানুষদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেবার লড়াইয়ে নামবে। সে লড়াই আর দানবিক জীবনের কথা ভাববে না, মানবিক জীবনের কথা ভাববে। জীবনটা সেদিন কৌতুকের রঙ্গমঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসবে রাজপথে।

সৈয়দ শামসুল হক ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ নাটকের মতো নূরুলউদ্দিনের মতো একটা সাধারণ মানুষ পাবো। নামটা শুনে মনে হতে পারে বোকাসোকা একটা মানুষ। সৈয়দ শামসুল হক খুব দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ‘এই নামটার মধ্যে একটা ইস্পাতসম কাঠিন্য আছে, আছে অগ্নিশিখার অমিত আহবান, আছে আমার দেশের মাটির গন্ধের সাথে মিশে থাকা মাতাল এক অনুভূতি, আছে কাল পূর্ণিমায় রক্তলোলুপ হায়েনার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য গগণবিদারী কণ্ঠে ডেকে ওঠা এক প্রতিধ্বণির আশ্বাস। জাগো বাহে কোনঠে সবাই’। আর ঘুম নয়, জড়তা নয়, ভেঙে পড়া নয়। জেগে উঠার এই তো সময়।

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। পৃথিবী আজ যে পথ হারিয়েছে, সে পথ খুঁজে পেতে সবাইকে তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। বুকে থাকবে সাহস, অন্তরে থাকবে সততা। হয়তো এমন দুর্দিনে যখন জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যায় সে সময়টাই শ্রেষ্ঠ সময়ের খাতায় নাম লেখায়। ইতিহাস তো তাই বলে। যে ইতিহাস ফুল দিয়ে সভ্যতার মালা গাঁথে।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন