নুসরাতের সাজানো মামলা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন

নিজেস্ব প্রতিবেদকঃ

এক ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের। প্রথম মামলা খারিজের পর দ্বিতীয় মামলাকে পাশ কাটিয়ে তদন্তে গেছে তৃতীয় মামলা। রাজধানীর গুলশানে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামে এক তরুণীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এভাবেই আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। একটি ঘটনাকে ঘিরে একই বাদির একেক রকম অভিযোগ তথা ‘আত্মহত্যা প্ররোচনা’ মামলায় হেরে গিয়ে ‘হত্যা মামলা’ দায়েরের ঘটনাকে নজিরবিহীন বলেও মনে করছেন তাঁরা।

উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বক্তব্য, একই ঘটনায় একাধিক মামলা হতেই পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম রয়েছে। সাধারণত প্রথম মামলার কার্যকারিতা সম্পন্ন হলে দ্বিতীয় মামলা চালু হওয়ার কথা। আবার প্রথম মামলাটি প্রমাণ হলে দ্বিতীয় মামলা সক্রিয় করার সুযোগ নেই। এ ঘটনায় যেহেতু প্রথম মামলায় বাদির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি, সেহেতু দ্বিতীয় মামলায় অবশ্যই যেতে হবে। দ্বিতীয় মামলা তদন্ত না করে তৃতীয় মামলায় যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া একই ইস্যুতে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করারও কোন সুযোগ নেই।

জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন নুসরাত। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এবং অন্যান্য আলামত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, ‘আত্মহত্যার কোন প্ররোচনার ঘটনা ঘটেনি।’ দীর্ঘ চার মাস তদন্তের পর গত ১৯ জুলাই আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। শুনানি শেষে ১৮ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন আদালত। একই সঙ্গে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় এ মামলা থেকে সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দেন আদালত। পুলিশের এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নুসরাতের দেওয়া নারাজি আবেদনও নথিপত্র বিশ্লেষণপূর্বক খারিজ করে দেন।

অন্যদিকে, মুনিয়াকে ‘হত্যা করা হয়েছে’ দাবি করে ২ মে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার ভাই আশিকুর রহমান সবুজ। তিনি মামলায় অভিযুক্ত করেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনকে। কিন্তু প্রথম মামলা চলমান থাকায় এ মামলাটির কার্যকারিতা স্থগিতের আদেশ দেন আদালত। প্রথম মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে সবুজের মামলাটি চালু হওয়ার কথা। কিন্তু এর মধ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর একই ঘটনা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কথিত ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা করেন প্রথম মামলার বাদি নুসরাত। আদালত সেটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন।

অভিযোগ উঠেছে, মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় তার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজের করা হত্যা মামলা থেকে আসামি শারুন চৌধুরীকে রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। আইন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এর মাধ্যমে আইনের গুরুতর লংঘন হয়েছে বলে মনে করেন সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নুসরাতের করা প্রথম মামলা কার্যকারিতা হারালে ভাই সবুজের করা দ্বিতীয় মামলাটি তদন্তে আসবে। কিন্তু এটি না করে নুসরাতের করা তৃতীয় আরেকটি মামলা গ্রহণ ও তদন্তের নির্দেশ বিধিমত হয়নি। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, মুনিয়ার ভাইয়ের মামলা কেন ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে? ওই মামলা থাকা অবস্থায় আইন লঙ্ঘন করে কিভাবে আরেকটি মামলা হয়?

নুসরাতের হত্যা মামলাকে নজিরবিহীন বলছেন আইনজীবীরা : ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু এ বিষয়ে বলেন, ‘মুনিয়ার ভাইয়ের করা দ্বিতীয় মামলা স্টে ছিল নুসরাতের করা প্রথম মামলা পরিচালনার স্বার্থে। এখন যেহেতু প্রথম মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে তাই দ্বিতীয় মামলা চলবে। দ্বিতীয় মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে আর কোনো মামলা হতে পারে না। পূর্ববর্তী মামলায় বাদী যদি কোন গাফিলতি হয়েছে বলে মনে করে তাহলে সে নারাজি দিতে পারে। কিন্তু একই বিষয়ের ওপর আবারো মামলা করতে পারে না। এভাবে মামলা হয় না, আইনে নেই।’

এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় যে মামলা করা হয়েছে সেটা নিষ্পত্তির আগে একই বিষয়ের ওপর তৃতীয় মামলা হতে পারে না। যদি কেউ এ ধরনের মামলা করেও তাহলে তা খারিজ হয়ে যাবে। জুডিশিয়াল নোটিশে যখন সেই মামলা আসবে তখন তা খারিজ হয়ে যাবে। একই বিষয়ে একাধিক মামলা চলতে পারে না। যেহেতু একই ঘটনায় হত্যা মামলা আগেই করা আছে এ মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনে মামলা করার সুযোগ নেই। সে (নুসরাত) নারী বলে চাইলেই মামলা করবে? এটা হতে পারে না। নুসরাতের এই মামলা টিকবে না। কোর্ট বিষয়টি জানতে পারলে খারিজ করে দেবেন।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী আরফান উদ্দিন খান বলেন, ‘আত্মহত্যা প্ররোচনার’ পরে একই বাদীর ‘হত্যা মামলা’ দায়ের নজীববিহীন। আমার জীবনে এমন মামলা দেখিনি। তিনি বলেন, বড়ভাই (আশিকুর রহমান সবুজ) যে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন সেই মামলাটি স্থগিত থাকতে পারে না। কোর্টের উচিত ছিল এটি একই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করা। যেহেতু আত্মহত্যা রেজাল্ট এসেছে কোর্ট পিবিআইকে এই হত্যা মামলা দিতেই পারে না বলে আমি মনে করি। আত্মহত্যা যেখানে মেডিকেলি প্রমাণিত সেখানে হত্যা মামলা হয় কী করে! এই মামলা টিকবে না, পিবিআই বা যাকেই দিক ফাইনাল রিপোর্ট দেবে। এটি ১৫৪ ধারা কভার করে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, একই বাদী দুই ধরণের মামলা করায় সুবিধা পাবে বিবাদী। কারণ এক বাদী কিভাবে একেক সময় একেক ধরনের মামলা করেন তা তদন্ত কর্মকর্তার সামনে আসবে। আমার মনে হয় নুসরাত তার ভাইয়ের দায়ের করা মামলা গোপন করেছে, না হলে আদালত দুই মামলারই তদন্ত করার নির্দেশ দিত। কারণ একই ঘটনার একই সঙ্গে পৃথক দু’টি তদন্ত হতে পারে না। বাদী নিজে বলেছে আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলা, ময়না তদন্তে প্রমাণ হয়েছে আত্মহত্যা। সেসময় মুনিয়ার ভাই একটা হত্যা মামলা করে। সেই হত্যা মামলার রিপোর্ট এখন স্থগিত। এই অবস্থায় মুনিয়ার বোন আবার আরেকটা হত্যা মামলা করে। এটা পুলিশকে হয়রানি ছাড়া আর কিছু না। ভাইয়ের মামলা কেনো নুসরাত গোপন করলেন। নাহলে তো দুই মামলাই একসঙ্গে তদন্ত হওয়ার কথা।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলাই যখন ফাইনাল রিপোর্টে আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ মেলেনি সেখানে হত্যা মামলা আসবে কোথা থেকে। নতুন করে মামলা তদন্ত করে তো কোন লাভ হবে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট একই, আলামত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা একই। সেখানে নতুন করে তদন্ত করে কি পাবে।

আইন বিষেজ্ঞরা আরও বলছেন, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(২) অনুসারে কোন অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দন্ডিত করা যাবে না। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে কোন ফৌজদারি মামলায় একাধিকবার শাস্তি প্রদান করা যাবে না। এই বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ৪০৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে। ধারা ৪০৩ অনুযায়ী কোন উপযুক্ত আদালত কোন মামলায় একজন ব্যক্তির বিচার করে তাকে শাস্তি বা খালাশ প্রদান করলে ওই আদেশ বলবৎ থাকা অবস্থায় একই অপরাধের দায়ে পুনরায় তার বিচার করা যাবে না। আদালতের কাছে সত্য গোপন করে এ ধরনের মামলা যদি কেউ করেন তাহলে আদালত তা খারিজ করে দেবেন।

শারুনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় যা বলেছিলেন মুনিয়ার ভাই: এদিকে, গত ২ মে মুনিয়াকে ‘হত্যা করা হয়েছে’ উল্লেখ করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ। সবুজ বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে শারুনের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। এ কারণে শারুন মুনিয়ার মাধ্যমে আনভীরের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত তথ্য জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে অসম্মতি জানালে মুনিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত হন শারুন। এর প্রতিশোধ নিতে শারুনই সহযোগীদের নিয়ে মুনিয়াকে হত্যা করে। সবুজের দাবি, তার বোন মুনিয়াকে শারুন চৌধুরী ও তার সহযোগীরা ঘটনার দিন ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে ঢুকে হত্যা করে। পরে তার বোনের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে কৌশলে বাসা থেকে বের হন শারুন।

মামলার আবেদনে আরো বলা হয়, ‘আমরা তিন ভাইবোনের মধ্যে মোসারাত জাহান মুনিয়া তৃতীয়। তার বয়স ২১ বছর। সে মাধ্যমিক শেষ করে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে পড়াশোনার জন্য যথাসাধ্য সহযোগিতা করে আসছিলাম। ইতিমধ্যে আসামি নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের সঙ্গে আমার বোনের পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে মাঝে মধ্যে আসামি শারুনের সঙ্গে কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ হতো মুনিয়ার। আমার বোনকে হত্যার আগে তার কাছ থেকেই আমি এসব কথা জেনেছি ও শুনেছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় গত দুই বছর আগে আমার বোন নুসরাত জাহান (তানিয়া) ও তার স্বামী মিজানুর রহমানের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে গুলশানে ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়িতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে। সেখানে আমার ছোট বোন নুসরাত আমার অপর ছোট বোন মুনিয়াকে ওই বাসায় অবস্থানের নির্দেশ দেয়। সেই মোতাবেক মুনিয়া সেখানে অবস্থান শুরু করে।’

মামলার আবেদনে আরও বলা হয়, ‘আসামি নাজমুল করিম শারুন আমার কোমলমতি বোনকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার ও ভোগ করেছে। আমার অধুনা মৃতা বোন মুনিয়া যখনই এই ঘৃণ্য চক্রান্ত থেকে বের হয়ে ফেরত আসতে চেয়েছে, তখনই শারুন আমার বোন মুনিয়ার ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষী, আমার বোন তানিয়ার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন সুকৌশলে আমার বোনের ফ্ল্যাটে ঢুকে অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করে মুনিয়ার মৃতদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে।’