নিজের হারানো ১৫টি মহিষ সাড়ে ১৩ লাখ টাকায় নিলামে কিনলেন সান্টু!

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মাচরের ভারতীয় সীমান্ত এলাকার কৃষক মো. সেন্টু মিয়া। প্রমত্তা পদ্মার বুকে জেড়ে ওঠা চরের নীলবোনা গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক তিনি। পদ্মার বুক চিরে সোনার ফসল ফলানোর পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই মহিষ পালন তার পেশা। দীর্ঘদিন থেকেই বিস্তীর্ণ সেই চরে শত শত মহিষপালের সঙ্গে ছিল ১৬টি মহিষ। কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ শত শত মহিষপালের মধ্য থেকে সেন্টুর মহিষগুলো পথভুলে পদ্মার অথই পানিতে নেমে হারিয়ে যায়। এক রাতে নিজের সন্তানের মতই লালন-পালন করা এতগুলো মহিষ হারিয়ে সেন্টুর পুরো পরিবার পাগলপ্রায়। পুরো চরসহ সীমান্তে কাঁদছিলো আর খুঁজছিলো আদরের ধনগুলোকে (মহিষ)। নিজের এতগুলো মহিষ হারানোর বিষয়টি স্থানীয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির ক্যাম্পেও জানিয়েছিলেন। হারিয়ে যাওয়ার ওই দিনই গোদাগাড়ীর প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে দিয়েছিলেন অভিযোগও।

এরই মধ্যে গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বেশ কয়েকটি মহিষ জব্দ করে। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখেন মহিষগুলো তার। সেন্টু মহিষগুলো নিজের বলে দাবি করলেও সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে না পারায় মহিষগুলোকে ফেরৎ দেয়নি কর্তৃপক্ষ। অবশেষে গত বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) ও বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃপক্ষ নিলামে তুললে ভ্যাট ও অন্যান্য খরচসহ মোট সাড়ে ১৩ লাখ টাকায় নিজের হারিয়ে যাওয়া ১৬টির মধ্যে ১৫টি মহিষ (একটি পাওয়া যায়নি) কিনে নেন।

বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় গিয়ে  নিলামে মহিষগুলো কেনার সময় মালিক মো. সেন্টু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘নিজের মহিষ তিনি নিজেই কিনলাম।’ মহিষগুলো আপনার এটি কীভাবে প্রমাণ করবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘এখান থেকে (গাড়ী থেকে যেখানে মহিষগুলো নামানো হয়) আমার বাড়ির দূরত্ব কমপক্ষে ২ কিলোমিটার। হেঁটে গেলে অন্তত ২০ মিনিটের রাস্তা। অথচ মহিষগুলো ছেড়ে দিলাম দেখবেন, একাই আমার বাড়ি চলে যাবে। এগুলোকে বাড়ি চেনাতে হবে না।’ যা কথা তাই কাজ! কয়েকজন সাংবাদিক কথার সত্যতা নিশ্চিত করতে নিলামে কিনে নেয়া মহিষগুলোর পিছু নিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা ছাড়াই মহিষগুলো সেন্টু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে পোঁছালো।

বাড়িতে পৌঁছানোর পর মহিষগুলোকে দেখে সান্টুর স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য মহিলারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দুই সপ্তাহ পর টাকার বিনিময়ে হলেও মহিষগুলো ফিরে পেয়ে তারা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে এগুলোকে আদর করতে লাগলেন। ১৪টি দিন কী খেয়েছে-না খেয়েছে এই ভেবে অতি আদর-যত্নে মহিষগুলোকে খাবার খেতে দিলেন। মহিষগুলোর প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা নাম দেওয়া আছে। যে মহিষটি পাওয়া যায়নি তার নাম ফুরকানি। বাড়িতে যাওয়া মহিষগুলোকে পাগলি, ঘণ্টি, যমুনা, ময়ূরী, ফুতনসহ নানা নামে নারীদের ডাকতে দেখা যায়। নাম ধরে ডাকলেই মহিষগুলো সাড়া দিচ্ছিল। মহিষগুলোকে দেখতে গ্রামের লোকজন ভিড় জমান। একবাক্যে সবাই বলেন, ‘এগুলোই সেন্টুর হারিয়ে যাওয়া মহিষ।’

আবেগাপ্লুত হয়ে সেন্টু জানান, সীমান্ত এলাকা বলে কার বাড়িতে কয়টি গরু-মহিষ আছে তার হিসাব রাখে বিজিবি। দুটি খাতায় তা লিখে রাখা হয়। একটি খাতা থাকে মালিকের কাছে, অন্যটি বিজিবির স্থানীয় ক্যাম্পে। গরু-মহিষের হিসাব ক্যাম্প কমান্ডার লিখে রাখেন তাঁর স্বাক্ষরসহ। তাঁর খাতার ক্রমিক নম্বর-২৯। এই খাতায় তাঁর ২১টি মহিষ থাকার হিসাব আছে। ৮ সেপ্টেম্বর যখন তিনি দেখেন ১৬টি মহিষ হারিয়ে গেছে, তখন বিজিবি ক্যাম্পকে জানিয়েই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। এ নিয়ে সেদিনই গোদাগাড়ীর প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে একটি অভিযোগও দেন। ৮ সেপ্টেম্বর খবর পান, রাজশাহীর চারঘাটের ইউসুফপুর বিজিবি ক্যাম্প কিছু মহিষ উদ্ধার করেছে। তিনি সেখানে গিয়ে মালিকানা দাবি করেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। একই দিন দুপুরে বাঘার আলাইপুর বিজিবি ক্যাম্পে আরও কিছু মহিষ উদ্ধারের খবর পান। তিনি সেখানেও যান। কিন্তু দুই ক্যাম্প থেকেই তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তার।

সেন্টুর দাবি- তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই ক্যাম্প থেকে মহিষগুলো বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। এরপর নিলামে বিক্রির জন্য বিজিবি সেগুলো কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের গুদামে পাঠায়। সেন্টু সেখানে গিয়েও মহিষগুলোর মালিকানা দাবি করে লিখিত আবেদন জানান। মহিষগুলো যে তাঁর সে ব্যাপারে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল প্রত্যয়নও দেন। কিন্তু সেন্টুর যে কপাল খারাপ! মহিষগুলো সেন্টুর কীনা এরজন্য কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষে এই মহিষ সেন্টুর নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার হাসনাইন মাহমুদ। সদস্য সচিব সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহাফুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন বিজিবির রাজশাহীর সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার কৌশিক আহমেদ এবং কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা ছাবেদুর রহমান। হাসনাইন মাহমুদ ও কৌশিক আহমেদের উপস্থিতিতে গত বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজশাহী নগরীর দাসপুকুরে শুল্ক গুদামে ১৫টি মহিষের প্রকাশ্যে নিলাম শুরু হয়। সেখানে যান সেন্টুও। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য লিটন হোসেনও। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

বুধবার আটটি মহিষ ৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। ওই দিন এই ৮টি মহিষের  নিলাম দিয়ে কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। প্রথম দিন যাঁরা মহিষগুলো কিনেছিলেন তাঁদের কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে সেগুলো কিনে নেন সেন্টু। দ্বিতীয় দিন নিজেই নিলামে অংশ নিয়ে বাকি ৭টি মহিষ ৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকায় কেনে তিনি। ভ্যাট ও অন্যান্য খরচসহ ১৫টি মহিষ কিনতে সেন্টুকে গুণতে হয় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা।

সেন্টু বলেন, তাঁর ১৬টি মহিষের বাজারমূল্য এখন অন্তত ২৫ লাখ টাকা। তিনি ১৫টি মহিষ কিনলেন সাড়ে ১৩ লাখে। এই সাড়ে ১৩ লাখ আর হারানো একটা মহিষের ক্ষতি তাঁর কাঁধে এলো। তিনি বলেন, ‘১৬টি মহিষের মধ্যে একটা কোথায় তা জানি না। নিলামে আসা ১৫টি মহিষের মধ্যে দুটি বলদ, ১৪টিই গাভী। এর মধ্যে নয়টি গর্ভবতী। ১০ দিনের মধ্যে চারটার বাচ্চা হবে। সবগুলোর বাচ্চা হওয়ার পর সাড়ে ১৩ লাখ টাকার ক্ষতিটাও উঠে যাবে। নিখোঁজ মহিষটার ক্ষতিও পুষিয়ে যাবে।’ কিন্তু এরপরও একটা ক্ষতি থেকেই গেল! এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে মামলা করবেন বলে জানান সেন্টু।

তবে সেন্টুর পালের মহিষ নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কার্যালয়ের রাজশাহীর যুগ্ম কমিশনার হাসনাইন মাহমুদ। তিনি মহিষের মালিকানা তদন্তে গঠিত কমিটি এবং নিলাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাসনাইন বলেন, ‘রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকার সুজন আলী নামের এক ব্যক্তিও সাতটি মহিষের মালিকানা দাবি করেছিলেন। তাই তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তে কারও মালিকানা প্রতিষ্ঠা পায়নি।’ অবশ্য মালিকানা দাবি করা ওই অন্যজন তদন্ত কমিটির সামনেও আসেননি। খোঁজ করে ওই ব্যক্তির সন্ধানও পাওয়া যায়নি। ওই ব্যক্তি কখন মালিকানা দাবি করেছিলেন সেটিও জানাতে চাননি এই কাস্টমস কর্মকর্তা।

এএইচ/এস