নিউইয়র্কে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ‘বামপন্থীরা’

২০০১ সালের ১৬ই নভেম্বর, টুইন টাওয়ারে হামলার মাত্র কিছুদিন পর  বাংলাদেশের একটি গ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের  কুইনসে আসেন মেরি জোবাইদা।

সেসময় তিনি বোরখা পরতেন, তবে লং আইল্যান্ড শহরে কালো আর ল্যাটিনো প্রতিবেশীদের মাঝে খুব বেশি ইসলামোফোবিয়ার অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়নি তাকে। জোবাইদা বলেন, ‘ আমাদের এই কমিউনিটি আমি যা, সেভাবেই আমাকে গ্রহণ করেছে। নাইন ইলেভেনের ঘটনার পরপরই আমি এখানে আসি, তবু কেউ আমাকে মুসলমান বলে অপমান করেনি কখনো, বরং তারা আমাকে এ ধরনের অপমান থেকে সবসময় বাঁচাতে চেয়েছে।

২৩ জুন হতে যাওয়া ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রাইমারিতে তিনি আ্যসেম্বলি মেম্বার ক্যাথি নোলানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১০ বছর আগে নোলানের বিজয়ের পর, এটাই এখানে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রথম প্রাইমারি।

জোবাইদা বলেন, অভিবাসী হিসেবে নিজের প্রথম দিককার অভিজ্ঞতাই যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ গঠনে সহায়ক হয়েছে। জেন্ট্রিফিকেশন, বা তথাকথিত মধ্যবিত্তীয় উন্নয়নের বিরোধিতা, কিংবা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সোচ্চার সমর্থন দেয়াটা তারই অংশ।

জোবাইদা একা নন। নিউ ইয়র্কের স্থানীয়, রাজ্য এবং কংগ্রেস নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন অন্তত আট বাংলাদেশি, যার মধ্যে নারীরাও রয়েছেন। এই নারীদের কেউ নারীবাদী, কেউ আবার নিজেদের মুসলমান হিসেবেই পরিচয় দেন, যারা মনে করেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিংবা কর্মসূচিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। লক্ষ্য একটাই, জোবাইদা বললেন, এস্টাবলিশমেন্টকে ধ্বংস করা।

এশিয়ান আমেরিকান ফেডারেশনের শুমারি বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড শিহ জানান, ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি জনসংখ্যা ৮৪,২৪৮।

ন্যাশনাল এশিয়ান আমেরিকান সার্ভের এক জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ৯০ ভাগই হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছিলেন। এশীয়দের অন্যান্য সাবগ্রুপের চেয়ে যা বেশি। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাও সবচেয়ে কম। সেই সাথে সর্বনিম্ন বেতনের পরিমাণ বাড়ানো এবং ধনীদের ওপর কর আরোপের তুমুল সমর্থক এই জনগোষ্ঠী।

সদ্য গঠিত তৃণমূল সংগঠন ‘বাংলাদেশি আমেরিকান ফর পলিটিকাল প্রোগ্রেস, বিএপিপি এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা তাহিতুন মরিয়ম বলেন, তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকানদের অনেকেই হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভ এর সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ (এওসি) এবং গত গ্রীষ্মে কুইনসের ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়া টিফানি কাবানের সমর্থক।

এওসির ২০১৮ সালের গুরুত্বপূর্ণ প্রচারণার পরিচালক ছিলেন নওরীন আক্তার। তিনি মুসলিম ফর প্রোগ্রেস নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিএপিপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ওকাসিও কর্তেজও তার প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনে এই সম্পদ্রায়টির সাথে যুক্ত হতে চেয়েছেন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বর্তমানে প্রাইমারিতে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্কের এক বাংলাদেশি, বদরুন খান।

সংগঠক আর প্রার্থীদের মতে, রাজনীতিতে বাংলাদেশি আমেরিকান জনগোষ্ঠীর এই উত্থানের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা।

প্রথমটি হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ওই যুদ্ধ ব্যাখ্যা করে, সার্বভৌমত্বের ধারণা বাংলাদেশিদের জন্য সুদূর অতীতের কোন বিষয় নয়।

মরিয়মের ভাষায়, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে,আমরাই তা নির্ধারণ করতে পারি।’আমাদের আগের প্রজন্মের অভিবাসীরা চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। আর আমরা চাই শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থা থেকে সরে আসা।

মুক্তিযুদ্ধের এক দশক পর জন্ম নেয়া জোবাইদা বলেন, তার প্রজন্মের মানুষ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রচণ্ড প্রভাবিত হয়েছিলেন। যখন এক সরকার এসে অন্য সরকারের আমলে ছাপা পাঠ্যবই নাটকীয়ভাবে বদলে দিল, বদলে দিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তিনি বলেন,

‘আমরা বড় হয়েছি এই প্রশ্ন নিয়ে, ইতিহাস আসলে কী?’

১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি বাসিন্দাদের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী আরেকটি ঘটনা, যা আরও বেশি সাম্প্রতিক, আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লাখও মুসলমানকে ফেডারেল এনএসইইআর রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এসময়। যার ফলে ফেরত পাঠানো হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে, যা জন্ম দিয়েছে গভীর অক্ষমতার অনুভূতি।

তবে মরিয়ম বলেন, বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা বয়স্ক পুরুষ রয়েছেন, যাদেরকে “চাচা” বলা হয়, তারা কেউ নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই করেননি, কিংবা বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করেননি, ‘চরমপন্থী’ তকমা পাওয়ার ভয়ে।

মরিয়ম বলেন, আমরা পরিণত হয়েছিলাম ক্ষমাপ্রার্থী মুসলমানে, আমাদেরকে সবসময় কৈফিয়ত দিতে হতো এই বলে যে, আমরা ‘সেরকম মুসলমান’ নই।

সম্প্রতি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ‘চাচা’দের এমন অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দৃষ্টিতে এই চাচারা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন, জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে চান না তারা, বরং প্রচলিত ব্যবস্থার দ্বাররক্ষক হিসেবেই থাকতে চান।

জোবাইদা বলেন, আমাদের প্রথম লড়াই ছিল এই চাচা প্রজন্মের বিরুদ্ধে।

মরিয়মের মতে, ট্রাম্প যুগে এসে বয়স্ক প্রজন্মের অনেকেই দেখলেন এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রেখে তাদের কোনই লাভ হয়নি। এই উপলব্ধিই পথ করে দিল এক নতুন নেতৃত্বকে, যাদের অধিকাংশই বড় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আগের প্রজন্মের মতো নয়।

উদাহরণ হিসেবে মৌমিতা আহমেদের কথা বলা যায়, যিনি চলতি মাসের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তার একটি টুইট সম্প্রতি ভাইরাল হয়, যেখানে ব্লুমবার্গ আমলে ঘটা তার শৈশবের একটি ভয়াবহ ঘটনার কথা বলেছেন তিনি। টুইটারবার্তায় বার্নি স্যান্ডার্সের এই প্রতিনিধি জানান, ২০০২ সালে মুসলমান নাম হওয়ার কারণে তার বাবাকে আটক করা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে পরিবারের কাছে ফোন পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি৷ এমনকি তাকে নিখোঁজ হিসেবে অভিযোগ জানাতেও পারেননি তারা। সে রাতে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে তারা খোঁজ নিয়েছিলেন, কোথাও কোন অজ্ঞাত লাশ আনা হয়েছে কি না। সেসময় মৌমিতার বয়স ছিল মাত্র ১২।

তবে নতুন এই বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েন শাহানা হানিফ। ব্রুকলিনের এই বাসিন্দা কাউন্সিলম্যান ব্র‍্যাড ল্যান্ডারের স্থান নেয়ার জন্য লড়ছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউন, টিন ভোগ আর দ্যা কাটে তার প্রচারণার সংবাদ তুলে ধরা হয়েছে।

১৭ বছর বয়সে আমার লুপাস রোগ ধরা পড়ে, আমার সম্প্রদায় আমাকে এসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, আমার মনে হয়েছিল আমি তাদের সাথে একাত্ম হতে পারছি। গথামিস্ট পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান শাহানা।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সংকটে পড়া বাংলাদেশি অভিবাসী নারীদের সাথে এসময় তার যোগাযোগ বাড়ে। তিনি অবাক হয়ে দেখছিলেন, মসজিদগুলো কীভাবে অসুস্থতাকে সামাল দেয়। যতই জানছিলেন, ততই ‘গ্লোবাল সাউথের’ ধারণার প্রতি আকর্ষণ বাড়ছিল তার। উন্নয়নশীল, এবং একসময় উপনিবেশিত দেশগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ বোঝানো হয় এই শব্দবন্ধটি দিয়ে।  আগের প্রজন্মের বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা’ও চিহ্নিত করতে পারেন শাহানা। তিনি বলেন, শ্রমজীবী শ্রেণির সংহতি গড়ে তোলার লড়াইয়ে বাংলাদেশিদের দেখিনি আমি, অন্যান্য বর্ণের মানুষের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিতেও দেখিনি।

অন্যান্য বাংলাদেশি প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন উবার চালক এবং শ্রমিক সংগঠক জয় চৌধুরী, যিনি আ্যসেম্বলি সদস্য মাইকেল ডেনডেকারকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আশাবাদী। রয়েছেন মাহফুজুল ইসলাম, যিনি আ্যসেম্বলি সদস্য ডেভিড ওয়েপ্রিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবং রয়েছেন সানইয়াত চৌধুরী, কংগ্রেসম্যান গ্রেগরি মিকসের সাথে লড়ছেন। এরা সবাই কুইনস থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

যেখানে অধিকাংশ বাংলাদেশিই রাজনীতি করছেন নিউ ইয়র্কে, সেখানে কমিউনিটি সংগঠক নাবিলা ইসলাম কংগ্রেস সদস্য হতে প্রার্থিতা করছেন জর্জিয়াতে। আটলান্টার এওসি নামে ডাকা হচ্ছে তাকে। নিউ ইয়র্কের কমরেডদের মতোই নাবিলাও শ্রমজীবী অভিবাসী পরিবারের সন্তান।

যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলা বিক্ষোভের মুহূর্তে, তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মীয়তার বোধ গড়ে উঠেছে। নিজেদের সংখ্যালঘু ধরাবাঁধা ধারণার বাইরে গিয়ে, এক নতুন আত্মপরিচয় গড়ার চেষ্টা করছেন তারা। জোবাইদার ভাষায়, আমাদের তরুণ প্রজন্ম ম্যালকম এক্সের মতোই মনে করে, যে কোন মূল্যে এই বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।