নাটকে ‘দেশিয় সংস্কৃতি’ তুলে ধরতে প্রমত্তা পদ্মায় ‘বাংলা নাট্যের নৌযাত্রা’

আমজাদ হোসেন শিমুল:

‘দেশিয় সংস্কৃতি’ বাঙালির হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। কিন্তু দিন দিন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জোয়ারে দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। এমনকি বর্তমানে বাংলা নাটকেও তুলে ধরা হচ্ছে না দেশীয় সেই সংস্কৃতি। বাংলা নাটকের দৃশ্যে বাঙালি জাতির শেকড় অনুসন্ধানের পরিবর্তে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ তথা ইউরেপিয়ান সংস্কৃতিকেই তুলে ধরা হচ্ছে। আর বাংলা নাটককে পশ্চিমা এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালির মনের জমিতে বিশ্বাসের শিকড় গাড়তে ‘দেশিয় সংস্কৃতি’ তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’।

শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাজশাহীর প্রমত্তা পদ্ম নদীতে ১৫টি নৌকাযোগে ‘বাংলা নাট্যের নৌযাত্রা’ শীর্ষক এক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘দেশীয় এই সংস্কৃতি তুলে ধরার দাবি জানানো হয়। সকাল ৯টায় মহানগরীর আলুপট্টি এলাকার পদ্মাপাড় থেকে ‘সাংস্কৃতিক এই অভিযাত্রা’ শুরু হয়ে জেলার চারঘাটের বড়াল পাড়ের ইলামিত্র মঞ্চের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এসময় আলাদা নামকরণে এই ১৫টি নৌকায় বসানো হয় ১৫ জন মনীষীর নামসহ প্রতিকৃত। সেই সাথে জাতীয় ও বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক দলের পতাকাসহ নৌকাগুলোকে দেশীয় সংস্কৃতিতে সাজানো হয়।

ব্যক্তিক্রমী এই আয়োজনে দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের কর্মীরা অংশ নেন। ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পদ্মা বড়াল থিয়েটার’ ও ‘রাজশাহী থিয়েটার’ ব্যতিক্রমী এই সাংস্কৃতিক কর্মসূচির আয়োজন করে। বিকাল ৪টা পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতিকে মানুষের মাঝে তুলে ধরতে চারঘাটের ইলামিত্র মঞ্চে ‘গম্ভীরা’, ‘আলকাপ’, ‘মাদার গান, ও ‘মনসামঙ্গল’ মঞ্চস্থ হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘বাংলা নাট্যের এই নৌযাত্রায়’ মনমুগ্ধকরভাবে সাজানো ১৫টি নৌকায় স্থান পাওয়া ১৫ মনীষীর মধ্যে রয়েছেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা, লালন সাইজী, মাস্টার দ্য সূর্য সেন, নাট্যাচার্য্য সেলিম আল দ্বীন, ঋত্বিক ঘটক, অক্ষয় কুমার মৈত্র, কবি রজনীকান্ত সেন, প্রফেসর আফসার আহমেদ, লোকনাট্য গবেষক কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল, বেগম রোকেয়া প্রমুখ। এছাড়া ১৫টি নৌকারও নামকরণ করা হয় ভিন্ন ভিন্ন। এর মধ্যে নৌকার উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো- ‘গম্ভীরা’, ‘আলকাপ’, ‘মাদারের পালা’, ‘মনসামঙ্গল’, ‘রামলীলা’, ‘কৃষ্ণ লীলা’, ‘মারমা জা’, ‘কারাম উৎসব’, ‘সঙযাত্রা’, ‘পুতুল নাচ’, ‘বাহা উৎসব’, ‘কবিগান’ ও ‘গাজীর গান’ ইত্যাদি।

ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক উৎসব ‘বাংলা নাট্যের নৌযাত্রা’র উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ‘ভোর হলো, রাজশাহী’র সভাপতি কামার উল্লাহ দৈনিক কালবেলা আনলাইনকে’ বলেন, ‘নাটক একটি শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম। বিশেষ করে লোকনাট্যের শক্তি অনেক। কিন্তু হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতিকে বিলীন করে দিয়ে ‘বাংলা নাটক’ আজ ‘ইউরোপিয়ান কালচার’ এর দখলে।

যেটি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা, সামন্ত সংস্কৃতির অবশেষসমূহ শিকড় গেড়ে বসে আছে। সমাজের কর্ণধারেরা পুরানো বস্তাপচা প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক মূলবোধ লালন করে চলেছে। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত থাকতে চাই। বাংলাদেশে মঞ্চে আমরা আমাদের নিজেদের জীবন, পরিমণ্ডল ও লড়াই এর চিত্র তুলে ধরতে চাই। আমাদের এই ‘সাংস্কৃতিক নৌযাত্রার মাধ্যমে আমাদের স্বকীয় নাট্য আঙ্গিক বিনির্মাণ করে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি জানাচ্ছি বাঙালির সহস্র বছরের প্রতিবাদী চেতনায় সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধাপরাধীদের শিড়ক চিরতরে উপড়ে ফেলার।’

‘বাংলা নাট্যের নৌযাত্রা’র এই কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন- ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ এর সভাপতি নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না, সংগঠনটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক লুৎফর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদ্বীপ কুমার আগারওয়াল ও কামার উল্লাহ সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ রিংকু, দপ্তর সম্পাদক জুবায়ের শিবলী, সদস্য রতন দাস ও এ্যাডভোকেট সুখময় বিপলু, রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ডা. আব্দুল মান্নান, রাজশাহী থিয়েটার এর সভাপতি নিতাই কুমার সরকার, রাজশাহী সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ ঘোষ প্রমুখ।

জি/আর