নবজাতকের যত্ন নিন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

একটা ঘরে যখন একটা নবজাতক শিশুর জন্ম হয়, তখন সবার মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। ধুম পড়ে মিষ্টি খাওয়ার। পাশাপাশি কিভাবে নবজাতক শিশুটিকে যত্ন-আত্তি করতে হবে এবং কিভাবে নিরাপদ ও সুস্থ রাখা যাবে সে চেষ্টা চলেও নিরন্তর। ক্ষেত্রবিশেষে অনেক সময় এটি হয় বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, না হয় একেবারে আনাড়ি ধরনের।

এ দুটিই কিন্তু বিপদ ডেকে আনতে পারে নবজাতকের জীবনে।

নবজাতক কাকে বলে?

সাধারণত শিশুর জন্মের প্রথম দিন থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় নবজাতক শিশু। এই নবজাতক শিশু আবার বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। যেমন—কারো জন্ম-ওজন হয় স্বাভাবিক, কারো ওজন হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি। আবার কেউ নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয়, কেউ পরে জন্মলাভ করে। আবার কেউ বা ঠিক সময়েই জন্ম নেয়। আর এসব ভিন্নতার জন্য নবজাতক শিশুদের সমস্যাগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

নবজাতক শিশুর যত্নগুলো খুবই ছোট ছোট অথচ দারুণ কার্যকর, যদি সেগুলো সঠিকভাবে মেনে চলা যায়। যেমন—

– প্রথম ও প্রাথমিক পরিচর্যা হলো একটি নবজাতক বাচ্চাকে উষ্ণ রাখা। গর্ভস্থ শিশুরা মায়ের জরায়ুর ভেতরে যে রকম উষ্ণ থাকে, পৃথিবীতে আসার পর সে রকম উষ্ণ পরিবেশে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে আসার পরপরই একটা নবজাতক শিশুর দ্রুত ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। এটা তার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। কাজেই এদিকটা সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে। নবজাতক শিশুর ঘরটিও উষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে হবে। এমনভাবে উষ্ণ রাখতে হবে যে নবজাতক শিশুটি যেন অতিরিক্ত গরমে ঘেমে না যায়, আবার ঠাণ্ডাও না লেগে যায়। বাচ্চাটি প্রস্রাব-পায়খানা করলে সঙ্গে সঙ্গে তার কাপড় পরিবর্তন করে দিতে হবে। ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া বুঝে তার পোশাক নির্বাচন করতে হবে। শিশুদের ডায়াপার বা প্যামপারস পরানোতে কোনো সমস্যা নেই, বরং নবজাতক শিশুটি তাতে আরামেই থাকবে। এর ফলে শিশুটির জামাকাপড় বা বিছানা ভিজে যাওয়ার এবং ঠাণ্ডা লাগার আশঙ্কাও কম থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডায়াপারে র‌্যাশ বা অ্যালার্জি হতে পারে। এ ছাড়া মারাত্মক কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে সেটা সাময়িক এবং এগুলো চিকিৎসা ছাড়া এমনিতেই নিরাময় হয়ে যায়।

– এর পরের যত্নআত্তি-প্রতি ঘণ্টায় তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে বা যখনই শিশুটি দুধ খেতে চাইবে তখনই তাকে চাহিদামতো বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সে শুধু বুকের দুধই খাবে। প্রথম দুধটাকে ‘শালদুধ’ বলা হয়, যেটা নবজাতক শিশুর জন্য রোগ প্রতিরোধকারী প্রথম টিকা বলা হয়ে থাকে। তাই জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, নবজাতক শিশুটি যতই বুকের দুধ টানতে থাকবে, মায়ের বুকের দুধ আসা ততই দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে হবে, ছয় মাসের আগ পর্যন্ত কোনো কৌটার দুধ, মধু, মিছরির পানি বা খাবার পানি ইত্যাদি বাচ্চার মুখে দেওয়া ঠিক নয়।

– জন্মের পরপরই সব নবজাতক শিশুর কমবেশি ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস হয়ে থাকে এবং সেটা সাধারণত দুই-তিন সপ্তাহ পর এমনিতেই চলে যায়। এ জন্য নবজাতক শিশুকে দৈনিক আধাঘণ্টা করে রোদে রাখতে হবে টানা তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। তাতে সে ভিটামিন ‘ডি’ পাবে এবং ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতিজনিত রোগ থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি তার জন্ডিসের প্রকোপটাও কমে আসবে।

তবে বাচ্চার ত্বক বেশি হলুদ মনে হলে, প্রস্রাব হলুদ রঙের হলে অবশ্যই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা উত্তম।

– নবজাতককে জন্মের পরদিন থেকে প্রতিদিন দুপুরে হালকা গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মোছাতে হবে এবং নাভি পড়ে না যাওয়া অবধি এ কাজটা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে বাচ্চার ত্বক পরিষ্কার থাকবে এবং গায়ে কোনো ইনফেকশন বা অ্যালার্জি হবে না। অবশ্য যেদিন নাভি পড়ে যাবে, তার পরদিন থেকেই গোসল দেওয়া যেতে পারে।

– আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নবজাতক বাচ্চার গায়ে আপাতত কোনো কিছু লাগানো বা মাখানো উচিত নয়। যেমন—তেল, সাবান, কাজল, লোশন, শ্যাম্পু, ভ্যাসলিন, ক্রিম, পাউডার ইত্যাদি। তাতে নবজাতক শিশুটির গায়ে অ্যালার্জি বা স্কিন ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।

– অনেকের প্রশ্ন থাকে, নাভিতে কোনো কিছু লাগানো লাগবে কি না? সাধারণত এটার দরকার পড়ে না। বলা বাহুল্য, জন্মের পরপরই লেবাররুমেই নবজাতকের নাভিতে এক ধরনের লিকুইড লাগানো হয়, যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এখন সর্বত্রই এই প্র্যাকটিস চলছে। এটাই নবজাতকের নাভির যত্নের জন্য যথেষ্ট, আর কিছু লাগানোর প্রয়োজন নেই।

– নবজাতক শিশুকে ইনজেকশন ‘কে-ওয়ান’ (২ মিগ্রা) মুখে খাওয়াতে হবে। সেটা জন্মের প্রথম দিন, চতুর্থ দিন ও ২৮তম দিনে। এটাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এর ফলে নবজাতক শিশুর রক্তক্ষরণজনিত সমস্যাগুলো দূর হবে, শিশুটি নিরাপদ থাকবে। এই প্র্যাকটিসটাও এখন সবখানেই চলছে। তবে কোথাও কোথাও মুখে খাওয়ানোর পরিবর্তে এটা নবজাতকের শিরায় বা মাংসে দেওয়া হয় এবং সে ক্ষেত্রে একবারই দিতে হয় বা একটা ডোজই যথেষ্ট।

– আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে নবজাতকের দেড় মাস বয়স হলেই নিয়মিত টিকাদান শুরু করতে হবে। এই সময় থেকেই জীবনরক্ষাকারী ১০টি টিকা দেওয়া হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই, একটি সিরিঞ্জের ভেতরে পাঁচটি টিকা সংযুক্ত থাকে, যেটা একসঙ্গেই দেওয়া হয়। তবে সুযোগ থাকলে এর আগেই শুধু বিসিজি বা যক্ষ্মা প্রতিরোধকারী টিকা দিয়ে নেওয়া ভালো। সরকারিভাবে এই ১০টি টিকা ছাড়াও আরো কিছু টিকা রয়েছে, সেগুলো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

– নবজাতক বাচ্চার বয়স দুই সপ্তাহ পার হলেই রুটিন চেকআপ করিয়ে নেওয়া শ্রেয়। কারণ এই সময়টাতে নবজাতকের শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ তার ওজন বাড়ল কি না, জন্ডিস কমল কি না এবং এ সময়ে ভিটামিনের ঘাটতিজনিত কারণে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া লাগবে কি না অথবা নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হলো কি না ইত্যাদি ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন নবজাতক বিশেষজ্ঞ বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চেকআপ বা পরামর্শ নেওয়া উত্তম।

– কোনো কোনো নবজাতক শিশুর চোখে পিঁচুটি জমে বা পানি পড়ে। এটা স্বাভাবিক এবং সহজেই নিরাময়যোগ্য। শুধু পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো কোনো মেয়ে নবজাতক শিশুর যৌনাঙ্গ দিয়ে সাদা বা লাল স্রাবের মতো তরল পদার্থ নিঃসরণ হতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে ভয়ের কিছু নেই। এটাও এমনিতেই নিরাময় হয়ে যায়। শুধু তার যৌনাঙ্গটা নিয়মিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। আবার কোনো কোনো বাচ্চা বেশিমাত্রায় মোচড়ানি দেয়, সেটাও স্বাভাবিক এবং সময়ের ব্যবধানে তা ঠিক হয়ে যায়।

– নবজাতকের যেকোনো ছোটখাটো সমস্যায় হেলাফেলা না করে দ্রুত নবজাতক বিশেষজ্ঞ বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

লেখক : ডিরেক্টর, ডক্টরস পয়েন্ট স্পেশালাইজড হসপিটাল, খুলনা

 

সূত্রঃ কালের কন্ঠ