নতুন ইসির অধীনে প্রথম নির্বাচন, তবু শঙ্কা-ভয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ি। এই উপজেলার একমাত্র এবং রাঙামাটি জেলার দ্বিতীয় পৌরসভা বাঘাইছড়ি। বছর দশেক আগে যাত্রা শুরু করা এই পৌরসভাটি শুরুতে সরকার নিয়োজিত প্রশাসক দিয়ে পরিচালিত হলেও পরে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আলমগীর কবির।

 

রাজনীতির কী অদ্ভুত সমীকরণ, এবারও মাঠে নৌকা আর ধানের শীষের প্রার্থীর প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুর রহমান। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচন।

 

বাঘাইছড়ি রাঙামাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। জেলার বাঘা বাঘা সব সাবেক ও বর্তমান রাজনীতিবিদের উত্থানও এই উপজেলা থেকে। ফলে এই পৌরসভার নির্বাচনকে খুব সিরিয়াসভাবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই। রাঙামাটি সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কামালউদ্দিন, প্রভাবশালী নেতা জ্যোতির্ময় চাকমা, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজন ও সম্পাদক প্রকাশসহ আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাড়ি এই উপজেলায়। আবার ভোটের রাজনীতিতেও এই উপজেলায় ভোটারের সংখ্যা অনেক বেশি। তার ওপর এর আগের নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষত, সঙ্গত কারণেই সব মিলিয়ে এই নির্বাচনকে মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিয়েছে দলটি। তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্ভেজাল মানুষ হিসেবে পরিচিত দলের ত্যাগী নেতা জাফর আলী খানকে মনোনয়ন দেওয়ার মধ্য দিয়ে দলটি প্রমাণ করতে চেয়েছে, তারা সত্যিকারভাবেই এখানে জিততে চায়।

 

অথচ গত পাঁচ বছর ধরে মাঠে পড়ে থাকা গত নির্বাচনে পরাজিত জমির উদ্দীনই দলীয় মনোনয়ন পাবেন, এমনটাই ধারণা ছিল সবার। কিন্তু নির্বাচনের দৌড়ে জমিরকে পেছনে ফেলে জাফর আলীই ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। রাঙামাটি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা দীপংকর তালুকদারের নেতৃত্বে পুরো আওয়ামী লীগই ঝাঁপিয়ে পড়েছে জয়ের লক্ষ্যে। এরই মধ্যেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিশাল কর্মী বাহিনীও পৌঁছে গেছে সেখানে।

 

একসময় বাঘাইছড়ি উপজেলায় বেশ প্রভাব নিয়েই ছিল বিএনপি। জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি হাজি মো. শাহ আলম, সাবেক সম্পাদক প্রয়াত অধ্যাপক জহির আহম্মেদ, রাঙামাটি পৌর বিএনপির সভাপতি শফিউল আজম, জেলা যুবদলের সম্পাদক মো. ইলিয়াছসহ বিএনপির অসংখ্য জ্যেষ্ঠ নেতার বাড়ি এই উপজেলায়। সঙ্গত কারণেই মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে এই নির্বাচনকে সিরিয়াসলিই নিয়েছে বিএনপি। পার্বত্য রাজনীতির নানা মেরুকরণ এবং বাঁক বিবেচনায় এখানে বিএনপির প্রার্থী বরাবরই শক্তিশালী প্রার্থী। বিএনপিও সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে এখানে ধানের শীষের প্রার্থী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ওমর আলীকে বিজয়ী করতে। তবে এখানে বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা সেলিম বাহারি ও বর্তমান মেয়র আলমগীর কবিরকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাদের সমর্থকদের ক্ষোভ কিংবা অসন্তোষ ওমর আলী কতটা অতিক্রম করতে পেরেছেন তা বোঝা যাবে ভোটের দিনের শেষ বিকেলে।

 

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে তৃতীয় প্রার্থী আজিজুর রহমান আজিজ। মারিশ্যা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা আজিজ নানা কারণেই বাঘাইছড়ির পরিচিত মুখ এবং সেখানে তাঁর রয়েছে নিজস্ব একটি সমর্থক গোষ্ঠী। একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকা আজিজকে নির্বাচন থেকে সরাতে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু অনড় আজিজ নির্বাচন থেকে সরেননি। নিজের সমর্থকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদ্রোহীদের নীরব ভোট ও প্রচ্ছন্ন সমর্থন তাঁর অন্যতম শক্তি বলে মানছেন প্রতিপক্ষরাও। দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মোবাইল প্রতীকের বিজয়ের সম্ভাবনাও তাই উড়িয়ে দিতে পারছেন না কেউই।

 

মজার ব্যাপার হলো, বাঘাইছড়ি উপজেলার সবগুলো ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা পাহাড়ি হলেও পৌর এলাকায় ভোটে বাঙালিরা সংখ্যায় এগিয়ে থাকায় এখানে ভোটের হিসাবে সুবিধা করতে পারেন না পাহাড়ি প্রার্থীরা। ফলে তাঁরা বারবার উপজেলায় বিজয়ী হলেও পৌরসভায় প্রার্থী হন না, কিন্তু জয়-পরাজয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পৌরসভার নয়টি কেন্দ্রের প্রায় ১০ হাজার ১১৭ ভোটারের এই পৌর এলাকায় পাহাড়ি ভোটার প্রায় এক হাজার ৭০০। এই ভোটাররা আবার পাহাড়ের তিন আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা), জনসংহতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ- তিন ভাগে বিভক্ত। বাঘাইছড়িই পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র উপজেলা যেখানে এই তিন সংগঠনের কমবেশি সমান আধিপত্য বিদ্যমান। ফলে এদের ভোট কোন প্রার্থীর বাক্সে যাচ্ছে সেটাও নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলাই যায়, এই উপজেলায় বাঙালি ভোটারদের প্রায় নব্বই শতাংশই আদিবাসী বাঙালি এবং এখানে পুনর্বাসিত বাঙালি ভোটও তেমন একটা নেই।

 

এদিকে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তিন প্রার্থী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, সরকারের উন্নয়নের প্রভাব পড়বে এখানে। ভোটাররা দেশের অন্যান্য স্থানের মতো নৌকাকেই নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে বেছে নেবেন। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে বিএনপি দাবি করছে, যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে বিজয়ী হবে ধানের শীষ।

 

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি হাজি মো. শাহ আলম বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে এই সরকারের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। তবু শঙ্কার মধ্যেই আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। আশা করছি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এবং সেটা হলে আমরাই বিজয়ী হব।’

 

নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ‘আমরা জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষই হবে। বিএনপি নিশ্চিত পরাজয়ে জেনে উল্টোপাল্টা অভিযোগ করছে। ভোটের দিনই আপনারা সব দেখবেন।’

 

সব কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ

বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচনের নয়টি কেন্দ্রের সবকটিকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নাজিমউদ্দিনও বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ‘এখানকার বাস্তবতা একটু অন্য রকম। তাই সবকটি কেন্দ্রকেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ, যেটাকে আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ বলেন, সেই হিসেবেই বিবেচনা করছি।’

 

বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও নয়টি কেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দাবি করা হয়েছে।

 

বহিরাগত প্রবেশের অভিযোগ

রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি হাজি মো. শাহ আলম বলেন, ‘রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে যারা ভোট ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা সবাই এখন বাঘাইছড়িতে অবস্থান করছে। এখানকার সব হোটেল রেস্ট-হাউস সরকারি দলের নেতাকর্মীদের দখলে এখন। আমরা আশঙ্কা করছি বাঘাইছড়িতেও রাঙামাটির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’

 

শাহ আলম বলেন, ‘মঙ্গলবার বাঘাইছড়ি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমরা নির্বাচনের আগেই বহিরাগতদের বের করে দেওয়া এবং প্রতিটি কেন্দ্রে বিজিবি নিয়োগের দাবি জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনাররা দায়িত্ব নিয়েছেন। এই নির্বাচন তাঁদের অধীনে প্রথম নির্বাচন। সুতরাং তাঁরা প্রথম পরীক্ষায় পাস করলেই বোঝা যাবে, তাঁদের অধীনে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কি না। তিনি বিভিন্ন এলাকায় ধানের শীষের কর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।

 

চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন

রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা নাজিমউদ্দিন বলেন, বহিরাগতদের পৌর এলাকা ছাড়ার জন্য বুধবার থেকে মাইকিং শুরু হয়েছে। আশা করছি সবাই বেরিয়ে গিয়ে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, ‘বিজিবি প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে টহল দেবে এবং আমরা বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।’

 

নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘এটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য, কারণ নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়েই এই নির্বাচন। আমরাও চেষ্টা করছি সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন করতে। সবার সহযোগিতা পেলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।’

সূত্র: এনটিভি