নওগাঁর মান্দায় কার্ডে উত্তোলনের সই, চাল পায়নি কেউ

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:


দরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণের কার্ড জালিয়াতি করে চাল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ডিলারদের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে দরিদ্রদের তালিকা করে ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণের কার্ড হলেও গত পাঁচ বছরে কোনও দরিদ্র পরিবার চাল পায়নি। এমন অভিযোগ তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শংকরপুর এলাকাসহ পুরো ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।
শংকরপু গ্রামের আজি মুদ্দীন, হাছেন আলী, সাত্তার মৃধা, চন্দন কুমার, অমূল্য কুমার ও বিরেনসহ ২৪ জন অভিযোগ করে বলেন, গত কয়েকদিন আগে ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আতাউর রহমান আমাদের ঘরে ঘরে ১০ টাকা কেজি দরে চাল ক্রয়ের জন্য কার্ড দিয়ে যায়। আমরা প্রথমে ভেবেছি হয়তো নতুন কার্ড হয়েছে। পরে তারা দেখতে পান কার্ডের ভেতরে গ্রহীতার স্বাক্ষরের ঘরে আঠারোবার চাল উত্তোলনের স্বাক্ষর । তারা দাবি করেন, গত ইউপি নির্বাচনের পর থেকে কোনও কার্ড পাননি এবং ১০ টাকা দরে চাল উত্তোলন করেননি। চাল কে পেয়েছে এ প্রসঙ্গে তারা ডিলার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সুলভ মূল্যে কার্ডে চাল বিক্রির জন্য তেঁতুলিয়া ইউনিয়নে দুটি ডিলারশিপ রয়েছে।
জয়পুর গ্রামের মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. সজল প্রাং এবং তেপাড়া গ্রামের মিজানুর রহমানের নামে এই দুইটি ডিলারশিপ।
২০১৬ সালের মার্চে ইউপি নির্বাচনের পর সেপ্টেম্বরে নতুন করে দরিদ্রদের জন্য সরকারের দেয়া ১০ টাকা মূল্যে চাল ক্রয়ের কার্ড তৈরি হয়। কিন্তু সেই কার্ড দরিদ্রদের কাছে বিতরণ না করে ইউপি চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ শাহার যোগসাজশে ডিলারদের সাথে সমাঝতা মাধ্যমে কার্ড রেখে দেয়। আর এই ফাঁকে খাদ্য অধিদফতরের থেকে দরিদ্রদের জন্য যতবারই চাল গিয়েছে ততবারই গ্রহীতার স্বাক্ষরের ঘরে ভুয়া টিপসই/স্বাক্ষর দিয়ে চাল উত্তোলন করে আসছেন।
কয়েকদিন পূর্বে ইউপি চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ সাহার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম ও দূর্নীতির জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ হলে মেম্বাররা ঘরে ঘরে গিয়ে পুরাতন কার্ডগুলো বিতরণ করে। এরফলে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বাড়ির প্রায় প্রতিটি সদস্যদের নাম রয়েছে সরকারি সুবিধাভোগী কোন না কোন নামের তালিকায়।
সরেজমিনে ১০ টাকা কেজির চালের ১১৭৫ জনের তালিকায় ৫৫ জনের নাম ও ঠিকানা মোতাবেক গিয়ে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া না গেলেও গত ৫ বছর যাবত তাদের নামে এবং স্বাক্ষরে চাল উত্তোলন করা হচ্ছে।
ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের ৩ নং ওয়ার্ডে কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বসবাস না করলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯ জনের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। যারা কি-না ২০১৬ সাল থেকে নিয়মিত চাল উত্তোলন করেছেন।
সাবাই গ্রামের মোঃ মুরশিদ বলেন, সাত্তার মেম্বার গতকাল এসে আমার হাতে একটা কার্ড দিয়ে যায়। সেখানে দেখছি প্রায ৫ বছর ধরে আমার নামে চাল উঠছে। অথচ আমি একবারও চাল তুলিনি।
একই গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের অভিযোগ আমি স্বাক্ষর করতে পারিনা। টিপসই দিই। অথচ ৫ বছর ধরে অন্য কেউ আমার নাম সই করে চাল তুলে খাচ্ছে।
নারায়ণপুর বাজারের ডিলার মিজানুর রহমান জানান, ‘গ্রাহকের কার্ডগুলো সর্বশেষ মাত্র দুই-তিন মাস ছিল আমার কাছে। এর আগে কার কাছে দরিদ্রদের এই কার্ড ছিল আমি জানি না। খাদ্য অধিদফতর থেকে চাল আসলে দরিদ্ররা কার্ড নিয়ে আসলে আমি চাল ১০টা দরে বিক্রি করি। আমি আর কিছু বলতে পারবো না।’
স্থানীয় সাত্তার মেম্বার জানান, চেয়ারম্যানের নির্দেশে তেঁতুলিয়া গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের কার্ড পার্শ্ববর্তী শংকরপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগমকে দিয়েছিলাম। গত ৪ বছর মনোয়ারা বেগমই এসব চাল উত্তোলন করেছে। তবে তিনি ভুল স্বীকার করে বলেন কয়েক দিন আগে আমি গিয়াস উদ্দিনের কার্ড মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে এনে গিয়াসকে ফেরত দিয়েছি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা কার্ডের কিছু অনিয়ম হয়েছে স্বীকার করে বলেন, ‘ভুল মানুষের হয়, ফেরেস্তার ভুল হয়না। তবে ওই সময় কার্ডগুলি সচিব বিতরণ করেছে। তবে কার্ডে বেশকিছু নাম, বাবার নাম ঠিকানায় কিছু ভুল হয়েছে। আমি সেগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করছি’।
তিনি শেষ বারের মতো ক্ষমা চেয়ে বলেন, ‘আমাকে এবারের মতো পার করে নেন’।
মান্দা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল হালিম বলেন, ‘চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের লিখিত অভিযোগের প্রক্ষিতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটির রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হবে ।’
স/আ