মঙ্গলবার , ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

দুর্নীতি-অনিয়ম: নওফেলের নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যে শিক্ষার বারোটা

Paris
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলির ঘটনা রয়েছে। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হওয়ার পর পাঁচ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে সাত গুণ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সরকারে দীর্ঘদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন ও নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি পাঁচ বছর আগে নিয়ন্ত্রণে নেন নওফেল। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) শিক্ষক নিয়োগও ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে।

অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী থাকাকালে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের এই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে।

গত ২০ আগস্ট বিএফআইইউ নওফেল এবং তাঁর পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্যও চেয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর হামলার নির্দেশদাতা হিসেবে কমপক্ষে এক ডজন মামলার আসামি হয়েছেন নওফেল। চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণকারী দুর্বৃত্তদের বেশির ভাগই তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া-চকবাজার) আসনে টানা দুইবারের সাবেক এই সংসদ সদস্যের কোনো খোঁজ নেই। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন থেকে তিনি পলাতক। কেউ কেউ বলছে, নওফেল পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। তবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে তিনি এখন কোথায়।

বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী ও মন্ত্রী থাকাকালে বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে, যেখানে প্রতিটি বদলি সুপারিশের জন্য কয়েক লাখ টাকা নিতেন।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে নিয়েছেন। বোর্ডের কেনাকাটার সব কাজ পেতেন তাঁর বলয়ের ঠিকাদাররা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সিভাসুর শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দিতেন। এ ছাড়া রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্যও সুপারিশ করেন নওফেল। এমন একটি সুপারিশনামা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম নসরুল কাদির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি শিরিন আক্তারের সময়ে শিক্ষক নিয়োগ থেকে বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। এসবের সঙ্গে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর যোগসাজশ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। সাবেক ভিসির বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরাও বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। ইউজিসি থেকেও তদন্ত হয়েছে। এর পরও সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক ভিসির সঙ্গে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর যোগসাজশ ছিল।’

সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুহা. ইদ্রিস আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এককথায় শিক্ষার বারোটা বাজানোর পেছনে দায়ী নওফেল। শিক্ষা তো অনেক বড় মন্ত্রণালয়। সেখানে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পরিচালনা কমিটিসহ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে সুবিধা বাগাতেন নওফেল। তা না হলে নওফেলের সম্পদ বাড়ে কী করে?

তিনি বলেন, মহিবুল হাসান চৌধুরী নিজ ক্ষমতাবলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিএস) স্ত্রীসহ নিজস্ব লোকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে টাকাও নিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সিভাসুকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। মেধাবীদের নিয়োগ না দিয়ে ইচ্ছামতো অন্যদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজ শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে নওফেল তাঁর পিএসের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। এ ছাড়া কয়েক লাখ টাকা লেনদেনে বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হতো। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ-পরিদর্শক হিসেবে নিজের লোকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন নওফেল। তাঁরা ফলাফল জালিয়াতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্ম করলেও মন্ত্রী সব সময় নীরব ছিলেন। শিক্ষা বোর্ডে এসব কর্মকর্তা মন্ত্রীর জন্য খামে ভরে টাকা পাঠাতেন।

মুহা. ইদ্রিস আলী বলেন, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে ছেলের পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ উঠলেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেননি নওফেল।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখল

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ও টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। ২০০১ সালের ৮ মে সিটি করপোরেশনের দশম সাধারণ সভায় প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার জন্য সাময়িক অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ, জায়গা কেনা, বেতন-ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা খরচ করেছে সিটি করপোরেশন। সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবেই চলছিল।

অভিযোগ রয়েছে, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেন।

গত ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে নওফেল দখলে নিয়েছেন, তা তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল আলম।

চিঠিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ও অর্থায়নে ২০০১ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বরে সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করে আসছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত ট্রাস্ট দলিলের মর্ম অনুসারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে কর্মরত মেয়র পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এর ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটির মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ঘাটতি দূর করার জন্য চিঠি পাঠালে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চিঠির বিরুদ্ধে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা করেন। মামলাটি ২০১৬ সালের ১২ জুন খারিজ হয়ে যায়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন চৌধুরী আপিল বিভাগে ৩১৪৩/২০১৭ নম্বর সিভিল পিটিশন করেন। আপিল বিভাগ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সিভিল পিটিশনটিও খারিজ করে দেন। এভাবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমেও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের আওতায় থেকে যায়।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হওয়ার পর নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেন।

একই চিঠিতে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে বর্তমানে একটি জনকল্যাণমূলক অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপটে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম সিটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে করপোরেশনের প্রতি লিখিত আবেদন করেছে।

এমপি হওয়ার পর সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ

মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পরই তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হন। তখন থেকে নওফেলের সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী উপমন্ত্রী হয়ে নওফেলের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় নওফেল তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৯২ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৬ টাকা, যার মধ্যে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণই ৯ কোটি ৯২ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৬ টাকা। পাশাপাশি স্ত্রীর নামে এক কোটি এক লাখ ৮৯ হাজার ৪১৯ টাকার সম্পদ তিনি দেখিয়েছেন, যার মধ্যে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার ৪১৯ টাকা।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নওফেল এক কোটি ৬১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩১ টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন হলফনামায়। তাঁর স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ ছিল তখন ৫৯ লাখ টাকা, যেখানে স্বামী-স্ত্রী কারো নামেই কোনো স্থাবর সম্পদ ছিল না। এবার নিজের নামে চার লাখ টাকার কৃষিজমি এবং এক কোটি টাকার দালান; স্ত্রীর নামে ৩৫ লাখ টাকার দালানের তথ্য দিয়েছেন হলফনামায়।

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ - জাতীয়