দুর্গাপুরে ফসলি জমি নষ্ট করে চলছে পুকুর খননের প্রতিযোগিতা,নিরব প্রশাসন


দুর্গাপুর প্রতিনিধি: রাজশাহী দুর্গাপুরে আবারো পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহামারি প্রতিযোগিতা। এ যেন দেখার কেউ নেই। যে দিকে চোখ পড়ছে সেদিকেই শুধু পুকুর খননের চিত্র। গত একমাস থেকে দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার বিঘা আবাদি জমিতে চলছে পুকুর খনন।

চাষিরা পুকুর খনন বন্ধের দাবীতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক অভিযোগ দিয়েও রক্ষা করতে পারছেন না তাদের ফসলি জমি। অভিযোগ ওঠেছে উপজেলা প্রশাসনের দপ্তরের কিছু কতিপয় ব্যাক্তিদের ম্যানেজ করে প্রভাবশালী নেতাদের ছত্র ছায়ায় ও পুলিশের সহযোগিতায় চলছে এই পুকুর খনন।

আর এই পুকুর খননের মুল সিন্ডিকেটের মুল ভুমিকায় রয়েছেন ভেকু দালাল নারায়ণপুরের মহিদুল, নওপাড়াও শফিকুল ইসলাম, আলিপুরের ফিরোজ, কিশমত গনকৌড়ের হাফিজ, কয়ামজামপুরের জাহাঙ্গীর, নান্দিগ্রামের আমিন, ঝালুকার মান্নান ও ঢাকা আমিন বাজার থেকে আসা ছলিম। তারা সন্ধ্যা হলেই থানায় বসে পুকুর খননের রেট নির্ধারণ করেন।

ওইসকল দালাল ও এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল কাউকে তোয়াক্কা না করে জমির শ্রেণী বদল করে দিনরাত বিরতিহীন ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে (এক্সোভেটর ভেকু) গাড়ী দিয়ে পুকুর খননের কাজ। আর অধিকাংশ পুকুর খননের মাটি স্থানীয় ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হচ্ছে। আর ওই সরবাহকৃত ট্রাক্টার গাড়ীতে করে মাটি বহনের কারনে সরকারের কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণকৃত গ্রামীন পাকা সড়ক হয়ে পড়ছে কাচা সড়ক সৃষ্টি হচ্ছে বড়বড় খানা খন্দক। আর এতে করে দুর্ভোগে পড়ছে সকল প্রকার যানবহন ও পথচারি। অন্যদিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন তারা।

অভিযোগ উঠেছে দুর্গাপুর থানা পুলিশ প্রতিটি পুকুর থেকে পার বিঘাপতি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে একটি দালাল চক্রকে পুকুর খননের সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছেন। এই পুকুর খননে এক্সোভেটর ভেকু দালালসহ দুর্গাপুরে অন্তত শতাধিক দালাল চক্র কাজ করছে। গত বছরে পুকুর খনন কাজে হাই কোর্ট থেকে নামে মাত্র রিটকপি নিয়ে যাচাই বাছাই ছাড়াই পুকুর খনন করলেও এবছরে কোন প্রকার রিটের প্রয়োজন হচ্ছে না। উপজেলার বাসির মাঝে এখন একটাই প্রশ্ন কেন পুকুর খনন বন্ধ হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে প্রায় ৪ শতাধিক স্থানে পাল্লা দিয়ে বড় বড় আয়তনের পুকুর ও দিঘি খনন কাজ চলছে। সরেজমিনে উপজেলার জয়নগর, নওপাড়া, কিসমত গণকৈড়, দেলুয়াবাড়ী, পানানগর, ঝালুকা ও মাড়িয়াসহ প্রায় সকল ইউনিয়ন এলাকার বিল গুলোতে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়। উপজেলার ওয়াজের মোড়ে পুকুর খনন করছেন আওয়ামীলীগ নেতা মোজাহার আলী ১৫ বিঘা, বাগমারা বিলে আব্দুল হালিম ৩০ বিঘা,  ঝলমরিয়া বিলে শহিদুল ইসলাম ১০ বিঘা, মাড়িয়া বিলে উজ্জাল ৮ বিঘা, মোস্তাক ৭ বিঘা,পানানগর বিলে মহিদুল ইসলাম ২৫ বিঘা, আংরার বিলে আওয়াল ৯০ বিঘা, নওপাড়া ও পালশার বিলে ইসলাম ৫০ বিঘা এছাড়াও দুর্গাপুর নারায়নপুর বাক্কার মেম্বার ২০ বিঘা, পাচুবাড়ী বিলে আলম ও বাক্কার ৩০ বিঘা, ইউসুফ আলী ও ভেকু দালাল মহিদুল ৭০ বিঘা, নামুদর খালি মুনছের ২০ বিঘা, আলীপুর বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন বিলে সালাম কালামের ৪০ বিঘা, সারপুকরিয়া বিলে সাবেক কাউন্সিলন ওবায়দুল ৫০ বিঘা, চুলকানি বিলে উজ্জল ৪৫ বিঘা, আনুলিয়া বিলে শহিদুল ৪০ বিঘা। এছাড়াও ধরমপুর, তেবিলা, কয়মজমপুর, আলীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে পুকুর খনন।

অভিযোগ পাওয়া গেছে পুকুর খনন করতে জমি লিজ না দিতে চাইলে জমির মালিকদেরকে বিভিন্ন ভাবে ভয়ভিতি প্রদান করে জোর করে জমি লিজ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও জমি দিতে না চাইলেও জোর করে রাতারাতি কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের জমি। উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৫ থেকে ৭ বছরে এই উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পুকুর খননের ফলে বিলিন হয়ে গেছে। তবে আগামিতে এভাবে যদি পুকুর খনন চলতে থাকে তা হলে এই উপজেলার আবাদী জমি হারিকেন দিয়েও খুজে পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

উপজেলার পাঁচুবাড়ি গ্রামের কৃষক কোবাদ আলী জানান, আমার জমি দিতে না চাইলেও স্থানীয় পুকুর খনন কারি আলিম জোর করে তার জমিতে পুকুর খনন করছে। ওই জমি ছাড়া আমার আর কোন জমি নেই। আমি তাদের কাছে নিরুপায় হয়ে পড়েছি।

কৃষক আমজাদ আলী জানান, এবছরে যে হারে পুকুর খনন হচ্ছে তাতে করে ওষধ করারমত ফসলি মাঠ আর খুজে পাওয়া যাবে না। এছাড়াও তার পান বরজের সাথে প্রভাবশালী আব্দুল হালিম অপরিকল্পিত ভাবে পুকুর খনন করছেন। ওই পুকুর খননের ফলে আগামিতে তাদের পান বরজের ভেতরে পানি ঢুকে পড়বে।

আম্বিয়া বেগম নামের এক নারী বলেন, বাবারে সারাবছর আমার ফাকা মাঠে গরু-ছাগল চড়িয়ে লালন পালন করে কোন রকম সংসার চালাই, পুকুর হয়ে গেলে কোথায় গরু-ছাগল চরণ করবো। উপজেলার কয়েকজন সচেতন ব্যক্তিরা জানান, এমনিতেই পুরো বাংলাদেশের মধ্যে দুর্গাপুরে সবচেয় বেশি পুকুর রয়েছে। বর্তমানে আবারো যে হারে পুকুর খননের কাজ চলছে তাতে করে আগামি বছরে আর কোন ফসলি জমি থাকবে না। এই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকিতে পড়বে।

তারা আরো জানান, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা চাষিদের ভুলভাল বুঝিয়ে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ৮ থেকে ১০ বছরের জন্য পুকুর খননের জন্য জমি লিজ গ্রহন করছেন। ফলে চাষিরা আগামি দিনে কথা না ভেবেই তারা তাদের জমি দিয়ে দিচ্ছেন ওই পুকুরে। চাষিদের সচেতন ও পুকুর খনান বন্ধ না করলে এই উপজেলার মানুষ এক সময় বড় ধরনরে বিপদগ্রামী হবেন। ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ফসলি জমি সুরক্ষায় সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন তারা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান জানান, কৃষি জমি সুরক্ষায় আইন আছে। তবে শ্রেণী বদল করে পুকুর খননের কোন আইন নেই। তার পরেও কোন অনুমতি ছাড়াই দুর্গাপুরে শ্রেণী বদল করে পুকুর খনন করা হচ্ছে। পুকুর খনন বন্ধ করা অতিব জরুরী। তা না হলে অচিরেই এই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বে।

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) শুভ দেবনাথ এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এবিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, ফসলি জমিতে পুকুর খননের অনেক অভিযোগ আসছে। তদন্তপুর্বক অবৈধভাবে পুকুর খনন ও মাটিবহনে দুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স/জে