দুদকের তালিকায় স্বাস্থ্যের দুই ডজন কর্মকর্তা

সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য পিপিই, মাস্ক ও মেডিকেল সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় দুই ডজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিভিন্ন স্তরের এই কর্মকর্তাদের নাম বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। শিগগিরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের তলব করা হবে।

দুর্নীতিতে জড়িত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের যোগসাজশে ইতোমধ্যেই প্রায় শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তারা জানান, ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঠিকাদারদের হাতে কাজ তুলে দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ওই কর্মকর্তাদের তালিকা ধরে অনুসন্ধানের কাজ চলছে। একদিকে অনুসন্ধানের কাজ চলমান থাকবে, অপরদিকে যখন যে তথ্য আসবে তার আলোকে তালিকায় নাম যুক্ত হবে। পর্যায়ক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হবে বলে জানায় দুদক সূত্র।

এদিকে মাস্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জেএমআই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুর রাজ্জাক ও তমা কনস্ট্রাকশনের সমন্বয়কারী মো. মতিউর রহমানকে বুধবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তবে তারা অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন।

তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেডের সমন্বয়কারী (মেডিকেল টিম) মো. মতিউর রহমান দুদক থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, মাত্র ৬০ পিস মাস্ক সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগে তাকে ডাকা হয়েছে। অপরদিকে জেএমআই’র আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, তিনি মাত্র ৪ লাখ টাকার মাস্ক সরবরাহ করেছেন। তার বিলও পাননি তিনি।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বুধবার টেলিফোনে  বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির নিবিড় অনুসন্ধান চালাচ্ছে কমিশন। অনুসন্ধানে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ের যাদের নামই আসুক বা তালিকা যত দীর্ঘই হোক, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো সিন্ডিকেট, প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তার মুখ দেখে অনুসন্ধান হবে না। দেখা হবে দুর্নীতি।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহর লিখিত একটি অভিযোগ যা চিঠি আকারে তিনি জনপ্রশাসন সচিবকে দিয়েছেন। সেখানে যাদের নাম এসেছে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারির পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বদলি হওয়া মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সব কর্মকর্তার বক্তব্য নেয়া হবে।

আর দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনকারী মুগদা মেডিকেল কলেজ ও খুলনা মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্টদেরও বক্তব্য নেবে দুদক। এছাড়া অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় পিপিআর ও পিপিএ’র অনুসরণ করে টেন্ডার ও কেনাকাটা হয়েছে কিনা সেদিকে।

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মার্চে জরুরি ভিত্তিতে বেশ কিছু করোনা সামগ্রী ক্রয় করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ডগ্লাভস ও মেডিকেল সামগ্রী। প্রথমে সরকারি মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মাস্ক ও পিপিই সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগ জেএমআই নামক একটি মেডিকেল সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

পরে জানা যায়, তমা কনস্ট্রাকশন ও এলান কর্পোরেশন নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাস্ক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এলান কর্পোরেশনের মালিক আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাস্ক জালিয়াতির ঘটনায় ২৫ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলাও হয়েছে। মামলাটি করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

এ পর্যায়ে মাস্ক ও পিপিই কেনাকাটা ও সরবরাহে অনিয়মের ঘটনা অনুসন্ধানে দুদকের গোয়েন্দা সেলের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি শক্তিশালী টিম গঠন করা হয় কমিশন থেকে। ওই টিম প্রথম ধাপে মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারির ঘটনা অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করলেও স্বাস্থ্য খাতে বিগত সময়ে সব ধরনের কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি বের করার ওপর জোর দিয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারির ঘটনা দিয়ে অনুসন্ধান শুরু হলেও এর আওতা বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য কেনাকাটা ও কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যক্তিগত দুর্নীতির নথিপত্রও তলব করা হয়েছে।

এ ছাড়া নানা মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতির তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হচ্ছে তালিকা। এই তালিকায় মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার নাম রয়েছে। যাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে দুদকের গোয়েন্দা টিম তাদের ওপর নজরদারিও বাড়িয়েছে। তালিকায় এখন পর্যন্ত দুই ডজন কর্মকর্তার নাম এসেছে। তবে অনুসন্ধানের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছে না দুদক।

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমডি) বিদায়ী পরিচালক (ভান্ডার ও সরবরাহকারী) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠি দেন গত ৩০ মে। ওই চিঠিতে তিনি সিএমএসডিসহ গোটা স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেট বাণিজ্যমুক্ত’ করার অনুরোধ জানান।

চিঠিতে সিএমএসডিসহ স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদার চক্রের ইশারায় বদলি, পদায়নসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। এ ছাড়া করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবায় সমন্বয়হীনতার চিত্র উঠে আসে তার চিঠিতে। এতে এই সেনা কর্মকর্তা সিএমএসডির ক্রয় প্রক্রিয়ায় সরকারি এবং সাপ্লাইয়ার (ঠিকাদার) পরিবেষ্টিত দুষ্টচক্র বা সিন্ডিকেট বাণিজ্যের আধিপত্য সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন।

দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহর এই অভিযোগ বা চিঠি তাদের অনুসন্ধানের অংশ। এর থেকে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও দুর্নীতির ক্লু তারা খুঁজে নিয়েছেন। একজন কর্মকর্তা বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের দুদকের বারান্দায় আসতে হবে। আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কেউ অসহযোগিতা করলে তাতে দুদকের অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, অসহযোগিতা যিনি করবেন, তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

জানা গেছে, দুদক থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে বেশ কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই দফতরের পরিচালক ডা. ইকবাল কবীরের ব্যক্তিগত নথিও তলব করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকে বেশ কিছু অভিযোগ অনুসন্ধানে রয়েছে।

দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ ১-এর পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের টিম আগে থেকে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্ত করে আসছে। তাদের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

 

সুত্রঃ যুগান্তর