দুদকের তদন্তে ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ হাইকোর্টের

অনুসন্ধান বা তদন্ত আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘ইতিবাচক’ কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন হাইকোর্ট।  বিশেষ বিধান থাকার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান, তদন্ত শেষ না করায় সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে উচ্চ আদালতের এক রায়ে।

হাইকোর্ট বলেছেন, দুদক আইনের ৩২ ধারা ও বিধি ১৫ অনুযায়ী কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা। দক্ষতার সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

গত ২৪ জানুয়ারি দুদকের মামলায় এক আসামির অব্যাহতির আদেশ বাতিল করে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীম হাইকোর্ট বেঞ্চ মৌখিকভাবে রায় দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার সেই পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানেই এসেছে এসব পর্যবেক্ষণ। ৭২ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। তার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন বিচারক মহি উদ্দিন শামীম।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা এবং দক্ষতার সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই দুর্নীতি এবং দুর্নীতি চর্চা নির্মূল হবে।  যদি কমিশনের কোনো কাজ, আদেশ, কর্যপ্রণালী এবং নিষ্ক্রিয়তা সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এবং দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন যদি যথাযথ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে, তবে সব প্রচেষ্টাই ব্যাহত হবে।

২০১১ সালের ২৬ জুলাই কুড়িগ্রাম পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মমিনুর রহমান ও সহকারী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলামকে ঘুস নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। দুদকের রংপুরের জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ওই দিনই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলার বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ৬ মে মো. জহিরুল ইসলাম মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।  শুনানির পর ওই বছর ১২ জুন রংপুরের বিশেষ জজ আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেয়।  বিশেষ জজ আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন হাইকোর্টে একটি রিভিশন পিটিশন দায়ের করে।

প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। জহিরুল ইসলামকে দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ কেন বাতিল করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় সেই রলে। চূড়ান্ত শুনানির পর রুলটি যথাযথ ঘোষণা করে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। বিশেষ আদালতে বিচারাধীন মামলাটির বিচার কাজ এক বছরের মধ্যে অথবা দ্রুত সময়ে শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, আজকাল আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, বড় বড় দুর্নীতির মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া তরান্বিত করার চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আত্মসাতের টাকা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। এর ফলে অভিযুক্তরা নিজেদের রক্ষায় সুবিধা পাচ্ছে বা সুবিধা নিচ্ছে। হাইকোর্ট বলেছেন, টাকা উদ্ধার দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ না, আইনেও সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। টাকা পুনরুদ্ধারে শুধু এটুকু প্রতীয়মান হয় যে, অভিযুক্ত বা ব্যক্তি অর্থ আত্মসাত বা পাচার করেছেন। তার মানে এটা বলা যাবে না যে, টাকা উদ্ধার হলেই অভিযুক্ত বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মামলা দায়েরের পর অনেক সময় পার হলেও বহু মামলার ক্ষেত্রে দুদক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র বা অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিতে পারেনি, যা স্পষ্টত আইনের বিধিবদ্ধ বিধানের লঙ্ঘন। তাছাড়া বিশেষ বিধান থাকা সত্ত্বেও এমন অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করেছি যে, দুর্নীতি করে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনেক সরকারি দপ্তরের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিন্তু সে মামলাগুলোর অনুসন্ধান, তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার জন্য ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ দুদক নেয়নি। তাছাড়া এ ব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না।  ফলে প্রশ্ন ওঠে, কমিশন কি আইনের ঊর্ধ্বে? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি, ২০০৭ – এ কমিশনের কার্যক্রম বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে। ফলে দেশের দুর্নীতি চর্চা বন্ধ করতে আইনগত অবস্থান থেকে কমিশনের উচিত আরও কঠোর হওয়া। তবে আইন এবং কর্যপ্রণালীর (বিধি) বাইরে গিয়ে অন্য কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, এই মামলায় আমি যুক্ত ছিলাম না। এ মামলার রায়ে উচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এ রায় আমাদের সবাইকে মানতে হবে।

উল্লেখ্য, কমিশন আইনের ২০ (ক) ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নতুন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে দুদক।

আর ২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার ৭ বিধিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লে­খ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন।  আর ২০ (খ) অনুযায়ী, তদন্তে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন আইন বা প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে কমিশন। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ ও ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদককে বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর