দুই বছরে ২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন সার গায়েব

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

দুই বছরে সরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন সার গিলে ফেলল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১ লাখ ৭৯ হাজার এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ৭২ হাজার টন। এই পরিমাণ সারের ক্রয়মূল্য ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন। একই সঙ্গে তিনি সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। টানা ২৬ বছর সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। সার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম করলেও কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাননি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তার ভয়ে আতঙ্কে থাকেন। অদৃশ্য শক্তির ইশারায় পোটনের দুর্নীতির তথ্য সব সময় ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হয়। তবে সম্প্রতি এই চক্রের বিরুদ্ধে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর একে একে দুর্নীতির তথ্য বেড়িয়ে আসছে। ইতোমধ্যে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত। সক্রিয় হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার আবদুল হালিম সার গায়েবের ঘটনাটি যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেন। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে দায়িত্বে থাকা বিএডিসির সাবেক যুগ্ম পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, কী পরিমাণ সার গায়েব হয়েছে, এর সঠিক তথ্য জানা নেই। তবে আমি যতদূর জানি, চট্টগ্রাম ছাড়াও মোংলা বন্দর থেকে পাঠানো সার পোটন ট্রেডার্স সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএডিসির তিনজন বর্তমান কর্মকর্তা এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশে ৪ ধরনের সার বেশি ব্যবহার হয়। এগুলো হলো ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি (পটাশ)। এর মধ্যে ইউরিয়া সার আমদানি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসি। বাকি সার আমদানি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি। গত বছর দেশে মোট সারের চাহিদা ছিল ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন, টিএসপি ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ এবং এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ টন। এর বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যার বেশির ভাগই পোটন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।

জানা যায়, বিএডিসির সার পরিবহণের জন্য ঠিকাদারির কাজ করে আসছে পোটন ট্রেডার্স। কিন্তু ২০২০-২১ সালের ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন সারের হদিস নেই। এর মধ্যে টিএসপি ১৮ হাজার ৭০০ টন, ডিএপি ৩০ হাজার টন এবং এমওপি ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। এই সারের ক্রয়মূল্য ৮০০ কোটি টাকা। কৃষকের কাছে সার বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেয়। আর ভর্তুকি বাদ দিলে দাম দাঁড়ায় ২৫০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাঠানো কয়েক লাখ টন সারের মধ্য ৮০ হাজার টন গায়েব হয়। অপরদিকে মোংলা বন্দর থেকেও টিএসপি, ডিএপি, এমওপি সার পোটন ট্রেডার্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সারগুদামে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৯৮ হাজার টন সারের হদিস মেলেনি। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর মিলিয়ে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ টন সার পোটন ট্রেডার্স বিএডিসিকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি।

২০২০-২১ সালের আমদানি করা এই সার গত বছর মে মাসের মধ্য বিএডিসির বিভিন্ন সারগুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু পোটন ট্রেডার্স সার না পৌঁছিয়ে কালক্ষেপণ করছে। বিএডিসি কর্তৃপক্ষ আমদানীকৃত সার দ্রুত বুঝিয়ে দিতে বারবার তাকে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া মিলছে না।

বিদেশ থেকে আমদানির পর সারের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর এবং মোংলা বন্দরে পৌঁছে। এরপর পরিবহণ ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্স সার বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়ে গুদামে পাঠাত। গুদামে সার না পৌঁছা পর্যন্ত বিএডিসি জানত না পোটন ট্রেডার্স সার কোথায় মজুত রাখে। এ সুযোগ নিয়ে পোটন ট্রেডার্স সার কালোবাজারে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করে বলে সূত্র জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএডিসির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন বিএডিসির প্রধান কার্যলয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনাটি জেনেও চুপ রয়েছেন। এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। সরকারের উচ্চপর্যায়ে বা দুদক ঘটনাটি তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে। ঘটনার সঙ্গে বিএডিসির অসৎ কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। এ ব্যাপারে বিএডিসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

এদিকে বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারের ৭১ হাজার ৯১৬ টন ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করেছে পোটন ট্রেডার্স। এর ফলে আর্থিক ক্ষতি ৫৮২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে অনুমতি চেয়ে ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিসিআইসি। কিন্তু এখনো সারা মেলেনি। তবে বিসিআইসির যাবতীয় কার্যক্রম থেকে গত ১৫ ডিসেম্বর পোটন ট্রেডার্সকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউরিয়া সার আমদানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করে (জিটুজি) সরকার। চুক্তি অনুসারে সার সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো হলো সৌদি আরবের সাবিক, কাতারের মুনতাজাত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্রোব। এই সার পরিবহণের জন্য ড্রাই বাল্ক শিপিং প্রাইভেট লিমিটেডের স্থানীয় প্রতিনিধি পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে ১৩টি চুক্তি করে সরকার। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আমদানির পর জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা। মোট আমদানি করা সারের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৪ টন। আর পুরোটাই বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে বুঝে নিয়ে পরিবহণ করে বাংলাদেশে আনে। কিন্তু গুদামে সরবরাহ করে ৩ লাখ ২১ হাজার ৩২৮ টন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে নিয়ে এলেও ৭১ হাজার ৯১৬ টন সার তারা গুদামে দেয়নি। এসব সরকারি-বেসরকারিভাবে বিক্রি করে দিয়েছে পোটন ট্রেডার্স। এই সারের ক্রয়মূল্য ৫৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ ৫৮২ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাপারে পোটন ট্রেডার্সের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে যুগান্তরকে জানানো হয়, এসব তথ্য সঠিক নয়। কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো. শাহাদাৎ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৬ সাল থেকে টানা ২৬ বছর তারা সরকারের সঙ্গে সারের ব্যবসা করছে। এ পর্যন্ত তারা বিসিআইসির ১ কোটি ১২ লাখ টন সার সরবরাহ করেছে। কিন্তু তাদের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব অপপ্রচার করছে।

সূত্র: যুগান্তর