তার পেশায় হলো প্রতারণা: চাকরির নামে রাজশাহীর শতাধিক যুবক খুইয়েছেন সর্বস্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ভুয়া নিয়োগপত্র ও জাল সনদপত্র দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রাজশাহীর এক প্রতারক যুবকের বিরুদ্ধে। যার কাজই হলো চাকরীপ্রার্থী যুবকদের নানা প্রলোভন দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। তার খপ্পরে পড়ে অন্তত শতাধিক যুবক সর্বস্ব হারিয়েছেন। চাকরির আশায় লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়ে অনেকেই এখনো টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন দপ্তরসহ পথে পথে করছেন। কেউ করেছেন মামলাও। এমনকি রাজশাহী শহরে রেস্টুরেন্ট খুলে নামমাত্র ব্যবসা করলেও সেখানে কর্মকরত যুবকদের বেতনও দেওয়া হয়নি। বেতন না পেয়ে ওই রেস্টুরেন্টের ৭ যুবক অভিযোগ করেছেন রাজশাহী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির কাছে।

এমন নানা প্রতারণার ফাঁদ পেতে চলে সেই যুবকের আলিশান জীবন। এটি করতে গিয়ে একাধিক বিয়েও করেছেন তিনি। ওই যুবকের নাম রনি রাজ হোসেন। তিনি বর্তমানে রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। তবে তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী থানার পাহাড়পুড় এলাকায়। তিনি ওই এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে।

রনির নানা প্রতারণার ফাঁদের একাধিক প্রমাণও উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। প্রতারক রনির ফেসবুক প্রোফাইলেও স্পষ্টই প্রতরাণার চিহ্ন দেখা গেছে, তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া আছে লেকচারার এট লেকচারার ইউনিবার্সিটি, পরিচালক আল নূর ডায়গনষ্টিক কমপ্লেক্স। কিন্তু তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত ছিলেন না। এমনকি রাজশাহীর লক্ষীপুরে তাঁর ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সের কথা বলা হলেও এর কোন অস্তিত্ব মেলেনি।

অনুসন্ধান ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, রনি রাজ হোসেন তাঁর ভুয়া নিউ টাইমস গ্রুপ খুলে রাজশাহীর পুঠিয়া এলাকার আক্তারুজ্জামান প্রিন্স নামের এক যুবককে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রায় এক দুই বছর খাটানো হয়। মাসিক ২৫ হাজার টাকার বেতন হিসেবে তাঁর পাওয়ান দাঁড়ায় তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু সেই পাওনা টাকার জন্য প্রিন্স রাজশাহীর আদালতে ২৫ জুলাই একটি মামলা করেছেন।

প্রিন্স বলেন, আমার মতো অন্তত ২৫ জন যুবককে রনি রাজ হোসেন বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রনি রাজ। কিন্তু কাউকেই বেতন দেন না তিনি। বেতন চাইতে গেলেই নানাভাবে হুমকি ধমকি দেওয়া হয়। আমার কাছ থেকেও সাড়ে তিন লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি টাকা দেয়নি।’

বাসিতুজ্জামান নামের আরেক যুবক বলেন, তাঁকেও আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুয়া নিয়োগ পত্র দিয়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছিলেন রনি রাজ হোসেন। শেষ পর্যন্ত রনিকে রাজশাহী নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল রবিউল ইসলামের কার্যালয়ে শালিস বৈঠকে রনিকে আটকে রেখে ওই টাকা আদায় করা হয়।’

বাসিতুজ্জামান বলেন, ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে অন্তত শতাধিক যুবকের নিকট থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রনি রাজ হোসেন। এটাই তাঁর মূল পেশা। আর সেই টাকা দিয়ে রাজশাহী শহরে দুটি নামকোয়াস্তে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালু করেন। সেখানে বিভিন্ন যুবকদের ডেকে নিয়ে তিনি মূলত নানা প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। তাঁর ওই রেস্টুরেন্ট দেখে মূলত যুবকরা আকৃষ্ট হোন। কিন্তু রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদেরকেই ঠিকমতো বেতন দিকে পারেন না রনি রাজ।’

বাঘার নাজমুল হোসেন নামের এক যুবক বলেন, তাঁকেও আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডে চাকরি দেওয়ার নামে তিন লাখ টাকা নেন রনি রাজ হোসাইন। তিনশত টাকার স্ট্যাম্পে এ নিয়ে একটি চুক্তিপত্রও স্বাক্ষর করেন রনি রাজ।

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার শুকুর আলী নামের এক ব্যক্তি জানন, তাঁর দোকান থেকে রনি রাজ হোসেন রেস্টুরেন্টের বেশকিছু মালামাল বাঁকিতে কেনেন। কিন্তু সেই টাকা পরে আর পরিশোধ করেননি। রনি রাজের নিকট থেকে ৫৩ হাজার টাকার এখনো পাবেন শুকুর আলী। ওই টাকা আদায়ে তিনি রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি মাজাহার হোসেন বলেন, রনি একজন প্রতারক। সে বিভিন্ন লোকজনের নিকট থেকে বিভিন্ন ভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।’
নওগাঁর মোস্তাকিন হোসেন নামের এক যুবক জানান, তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার নামে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেন রনি রাজ হোসেন। পরে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে দেখেন তাঁকে দেওয়া নিয়োগপত্রটি ভুয়া। এর পর টাকা আাদয়ের জন্য অব্যাহত চাপ দিতে থাকলে শেষ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন রনি রাজ। কিন্তু এখনো দেড় লাখ টাকা পাওনা রয়েছে মোস্তাকিনের।

নওগাঁর নিয়ামতপুর এলাকার গোলাম রাব্বানি জানান, তাঁকেও একটি ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার নামে আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নেন রনি রাজ হোসেন। ওই টাকার জন্য তিনি এরই মধ্যে রনিকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত টাকা না পেলে তিনি আদালতে মামলা দায়ের করবেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর অলোকার মোড়ে রনির ড্রিম ক্যাফে নামের একটু রেস্টুরেন্ট খুলে বিভিন্ন যুবকদের কাজ দেওয়ার নাম করেও অর্থ হাতিয়ে নেন। কিন্তু ওই যুবকদের মাসিক বেতনও পরিশোধ করেন তিনি। প্রতারণার শিকার হয়ে রকিবুল ইসলাম নামের এক যুবক রাজশাহী রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি জানান, তাঁর মতো অন্তত সাতজন যুবক রনির রেস্টুরেন্টে কাজ করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

এদিকে রনির বিরুদ্ধে জাল সনদ বিক্রিরও অভিযোগ উঠেছে, মনোয়ার হোসেন নামের এক যুবককে টাইমস ইউনিভার্সিটির জাল সনদ দিয়ে তার নিকট থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রনির বিরুদ্ধে।

এখানেই শেষ নয়, এসব করতে গিয়ে কখনো নওগাঁ, কখনো রংপুর, কখনো ঢাকা, কখনো পাবনা, কখনো জয়পুরহাটে বাসা ভাড়ি করে আশ্রয় নেন রনি। এটি করতে গিয়েও একাধিক বিয়ে করেছেন তিনি। তাঁর প্রথম স্ত্রীর সংসারে একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। প্রথম স্ত্রী শাহিদা আক্তার পরে রনির বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলাও করেছেন রংপুরের কোতয়ালি থানায়।
এদিকে রনির এসব অপকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি চাকরি দয়োর নামে কারো নিকট থেকে টাকা নেয়নি। ব্যবসায়ীক কারণে কিছু টাকা নিলেও সেগুলো ফেরত দিয়েছে। এখনো দিচ্ছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একজন যুবককে একটি ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নিলেও সেটি কাউন্সিলের মাধ্যমে ফেরত দিয়েছি। কাজেই কারো সঙ্গে প্রতারণা করেনি।’

রেস্টুরেন্টে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে। কাজেই আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সবই মিথ্যা। #

স/আর