তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণ: সভাপতিসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার তল্লায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এছাড়াও অভিযুক্ত আরও ৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে, তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগ পত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন।

আজ বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় সিআইডি কার্যালয়ে এ বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন।

সিআইডির তদন্তে অভিযুক্তরা হলেন, মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়া (৬০), মো. সামসুদ্দিন সরদার (৬০), মো. শামসু সরদার (৫৭), মো. শওকত আলী (৫০), মো. অসিম উদ্দিন (৫০), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪০), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (৪৫), মো. নাঈম সরদার (২৭), মো. তানভীর আহমেদ (৪৫), মো. আল আমিন (৩৫), মো. আলমগীর সিকদার (৩৫), মাওলানা মো. আল আমিন (৪৫), মো. সিরাজ হাওলাদার (৫৫), মো. নেওয়াজ মিয়া (৫৫), মো. নাজির হোসেন (৫৬), মো. আবুল কাশেম (৪৫), আব্দুল মালেক (৫৫), মো. মনিরুল (৫৫), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), মো. আসলাম আলী (৪২), আলী তাজম মিল্কী (৫৫), মো. কাইয়ুম (৩৮), মো. মামুন মিয়া (৩৮), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. বশির আহমেদ হৃদয় (২৮), মো. রিমেল (৩২), মো. আরিফুর রহমান (৩০), মো. মোবারক হোসেন (৪০) ও রায়হানুল ইসলাম (৩৬)।

 

অভিযোগ পত্রে সিআইডি উল্লেখ করে-গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০ টায় নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই অগ্নিকাণ্ডে মসজিদে ইবাদাতরত ৩৭ জন মুসল্লি ও ১ জন পথচারী অগ্নিদ্বগ্ধ হয়। তন্মধ্যে ৩৪ জন মুসল্লি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর অধীন শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ৪ জন এখনও নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসারত আছেন। অগ্নিকাণ্ডে মসজিদের এসি, থাই গ্লাসসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আগুনে পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ঘটনার ৫ দিন পর অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডি। তদন্তকালে সিআইডি ক্রাইমসিনসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, বস্তুগত আলামত সংগ্রহ করে ও অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদঘাটন করে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তিতাস গ্যাস টিএন্ডডি কো. লি. এর ফতুল্লা জোনের দায়িত্বরত ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদেরকে ২ দিন পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ডিপিডিসির ১ জন মিটার রিডার ও ২ জন ইলেকট্রিশিয়ানসহ মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইলেকট্রিশিয়ান মোবারক ও রায়হান অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তদন্তে মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পাওয়ায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুরকেও গ্রেফতার করা হয়।

সিআইডি’র তদন্তে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদ্ঘাটন করা হয়। ঘটনার পূর্ব হতে প্রায় তিন মাস যাবৎ মসজিদের পাশে তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ হতে গ্যাস বের হয়ে মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে। বাধাহীনভাবে গ্যাস উদগিরণ হয়ে মসজিদ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। ঘটনার ৭-৮ দিন পূর্ব হতে গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে মুসল্লিরা বিষয়টি মসজিদ কমিটিকে জানায়। কিন্তু মসজিদ কমিটি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

মসজিদ কমিটির সঠিকভাবে মসজিদ পরিচালনায় অবহেলা, অ-ব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষনাবেক্ষণ না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেয়া ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কো. লি. (ডিপিডিসি) এর মিটার রিডিং কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে মসজিদের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কো. লি. এর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ঘটনাস্থল এলাকার তিতাস গ্যাসের দায়িত্বে থেকে দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাস লাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন বা স্থানান্তর করার কারণে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়ে ৩৪ জন মুসল্লি অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ও ৪ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে সিআইডি’র তদন্তে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ঘটনার দিন এশার নামাজের সময় বৈধ বিদ্যুৎ লাইন চলে গেলে ম্যানুয়াল চেঞ্জওভারের মাধ্যমে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হলে বিদ্যুতের স্পার্ক হয়। তখন বিদ্যুতের স্পার্ক ও মসজিদে জমে থাকা গ্যাসের সমন্বয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন অগ্নিদগ্ধ মুসল্লিদের অটোরিক্সা ও রিক্সাযোগে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিলে সেখানে বার্ণ ইউনিট না থাকায় দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ণ ইউনিটে প্রেরণ করে। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় অগ্নিদ্বগ্ধ ৩৪ জন মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেন এবং ৪ জন মুসল্লি চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বাড়িতে আছেন।

তদন্ত গ্রহণের পর থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও নিরলসভাবে তদন্তকার্য পরিচালনা করে সিআইডি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়াসহ মোট ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে সিআইডি। অভিযুক্ত আরও ৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

এ বিষয়টি নিশ্চিত করে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন