ড্রাগন মাল্টাতেও বরেন্দ্র ভূমিতে ঘটেছে বিপ্লব

নিজস্ব প্রতিবেদক:


নওগাঁর সাপাহার উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ দিকে চার কিলোমিটার পথ পেরুলেই পড়বে ভাটপারুল গ্রাম। গ্রামটির চারিদিকে যেন সবুজের সমারোহ। যেদিকে নজর যায়, আমবাগান আর আমবাগান। তবে এই গ্রামের আধা-পাকা সড়ক ধরে একটু এগুলেই চোখে পড়বে বিশালাকার একটি ড্রাগন ফলের বাগান।

বিলের মাঝখানজুড়ে ড্রাগন ফলের বাগানটি যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মাথা উঁচু করে। আর ড্রাগনের বাগানের চারিদিকে রয়েছে আমবাগান। তবে আমবাগানকে ছাড়িয়ে ড্রাগন বাগানের দিকেই চোখ যাবে যে কারো। সারি সারি ড্রাগন গাছগুলো দেখতেও যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। বাঁশ দিয়ে তৈরী করা মাচার সঙ্গে ড্রাগন গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। আর যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ফলপ্রেমী মানুষদের।

গত ২৮ ডিসেম্বর এই ড্রাগন বাগানটি ঘুরে দেখা যায়, এখনো গাছে ফুল বা ফল আসেনি। তবে মাস তিনেকের মধ্যেই বাগানের গাছে গাছে ফুলে ভরে যাবে। এরপর আসবে লালজাতের ড্রাগন ফল। এই ফল বিক্রি করেই প্রথম বছরেই অন্তত ১২-১৫ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন বাগান মালিক মোখলেছুর রহমান। তিনিসহ ১০ বন্ধু মিলে এক ফসলি ধানি জমিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে বাগানটিতে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে বাগানে ড্রাগন উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করছেন তারা। প্রায় ৫০ বিঘা আয়তনের এই বাগানের একটি অংশের কিছু জমিতে রয়েছে আম, কিছু জমিতে রয়েছে মেওয়া বা শরিফা জাতের ফলও। মেওয়া গাছে এরই মধ্যে ফল আসতে শুরুও করেছে। মাস তিনেক পরে সেগুলো বাজারজাত শুরু হতে পারে বলেও আশা করা হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু এই ভাটপারুল গ্রামেরই নয়, বরেন্দ্র অঞ্চল সাপাহারসহ পোরশা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলেও হচ্ছে ড্রাগন চাষ। এক সময়ের এক ফসলি ধানি জমিতে ধানচাষ করে কৃষকরা অব্যাহত লোকসান থেকে বাঁচতে এখন আমসহ, ড্রাগন, পেয়ারা, মাল্টা, কমলা, লিচু, মেওয়া (শরিফা), বরই (কুল) এমনকি মরুর দেশের খেজুর চাষও শুরু করেছেন কেউ কেউ। আর এসব ফল চাষ করে এরই মধ্যে ভাগ্য খুলেছে শত শত চাষি বা কৃষকের।

উইকিপিডিয়া বলছে, ড্রাগন ফল যা পিতায়য়া নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম হাইলোসারিয়াস আন্ডাটাস ।এটি এক প্রজাতির ফল। একধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এর মহাজাতি হায়লোসিরিয়াস (মিষ্টি পিতায়য়া)। এই ফল মূলত ড্রাগন ফল হিসেবে পরিচিত। গণচীন-এর লোকেরা এটিকে আগুনে ড্রাগন ফল এবং ড্রাগন মুক্তার ফল বলে। ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল নামে চেনে। থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। অন্যান্য স্বদেশীয় নাম হলো স্ট্রবেরি নাশপাতি বা নানেট্টিকাফল। এই ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে। তবে লাল রঙের ড্রাগন ফল বেশি দেখা যায়। বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলে এই জাতের ডাগনই বেশি উৎপাদন হচ্ছে।

ভাটপারুল গ্রামের ড্রাগনচাষি মোখলেছুর রহমান জানান, তাঁরা ১০ বন্ধু মিলে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নওগাঁর পত্নীতলার আগ্রাদ্বিগুন গামের বিলে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে একটি ড্রাগন ফলের বাগান তৈরী করেন। ওই বাগান থেকে গত এক বছর ধরে তারা ফল বিক্রি করতে পারছেন না। এক ফসলি ধানি জমিকে ড্রাগন বাগানে রুপান্তর করে এরই মধ্যে প্রায় ৬-৭ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছেন বাজারে। এখনো ফল বিক্রি হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যেই ড্রাগন ফল চাষসহ যাবতীয় খরচ উঠে আসবে বলে আশা করছেন তাঁরা। ৎ

এছাড়াও ৭০ বিঘা জমিতে ড্রাগনের পাশাপাশি রয়েছে পেয়ারা, মাল্টা ও আম। এরই মধ্যে প্রায় ১২ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছেন তাঁরা। আর আমসহ অন্যান্য ফল বিক্রি করে আয় হয়েছে আরও প্রায় ২ লাখ টাকা। বছরে এখনোই তাদের প্রায় ২০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। সামনে যতদিন যাবে আয়ের পরিমাণ ততই বাড়বে। সেই হিসেবে আগামী দেড়-দুই বছরের মধ্যে বাগানের সব খরচ উঠে আসবে। বাগানটি করতে তাদের পায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে বছরে জমির বন্ধক নেওয়া বাবদ বিঘা প্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা করে ব্যয়। সেটিও অনায়াসে পরিশোধ করতে পারবেন তারা। অথচ এই পরিমাণ জমিতে ধানচাষ করে বছরে বড়োজোর ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। কিন্তু সেখানে জমির বন্ধকের জন্যই দিতে হচ্ছে ২০-২৫ হাজার টাকা করে। আর ভাটপারুলের জমির বন্ধকের জন্য বিঘা প্রতি দিতে হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা করে। এতে করে জমির মালিকরাও যেমন বসে থেকে ধানের চেয়ে বেশি টাকা আয় করতে পারছেন, তেমনি ড্রাগন বা আমসহ অন্যান্য ফল চাষ করে বিঘা প্রতি জমি থেকেই অন্তত ৫০ হাজার টাকা লাভ করতে পারছেন চাষিরা।

সাপাহার উপজেলা কৃষি দপ্তর থেকে জানা গেছে, শুধু সাপাহার উপজেলায় বর্তমানে প্রায় ২৫০বিঘা জমিতে মাল্টা, ২৫০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ও ১০০বিঘা জমিতে কুল বা বরই এর চাষাবাদ হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে পেয়ারা, শরিফা, লিচুসহ অন্যান্য ফলও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বাবু ডাইয়িং এলাকায় বাচ্চু নামের এক ব্যক্তি ১৭০ বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে সেখানে মাল্টা, সৌদি আরবের খেজুর, আম, কমলা চাষ করছেন। পাশাপাশি গরুর খামারো গড়ে তুলেছেন তিনি। এখান থেকে তার বছরে অন্তত ৩০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে বলে জানান তিনি।


এদিকে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘ফল চাষ এখন অনেকটা লাভজনক। এ কারণে বরেন্দ্রর এক ফসলি জমিতে এখন আম, পেয়ারা, মাল্টা, বরইসহ নানা জাতের ফল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। বিশেষ করে যেসব জাতের ফলের বাজারে চাহিদা আছে ব্যাপক, কিন্তু দেশে উৎপাদন কম সেসব ফল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এতে লাভভবানও হচ্ছে তাঁরা। তুলনামূলক হারে এক ফসলি জমিতে ফলচাষেই লাভ হচ্ছে বেশি।


তিনি আরও জানান, রাজশাহীতেই কেবল আম চাষ হচ্ছে ১৭ হাজার ৬৮৩ হেক্টর জমিতে। যার একটি অংশ চাষ হচ্ছে বরেন্দ্রর মাটিতে। এর বাইরে চাষ হচ্ছে লিচু ৫০০ হেকক্টর জমিতে, মাল্টা ১৫৮ হেক্টর, ড্রাগন ৮ হেক্টর, স্ট্রবরি ও কুল ৩৩৭ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। এসব ফল থেকে বছরে দেড়-দুই হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে।

স/জে