গোদাগাড়ীর ডিম বিক্রেতা বাসের সুপার ভাইজার দিনমজুররাও এখন কোটিপতি!

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গোদাগাড়ী প্রতিনিধি::
রাজশাহীর গোদাগাড়ী। এটি একটি উপজেলা। কিন্তু দেশের সীমান্তঘেঁষা বরেন্দ্র অঞ্চলের এই উপজেলাটির পরিচিতি হলো মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। যেন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। ঘরে ঘরে বিক্রি হয় দেদারছে মাদক। প্রশ্ন হলো এতো মাদক আসে কোথা থেকে? এর উত্তর দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে এবং সম্প্রতি গড়ে উঠা নতুন রুট হিসেবে দেশের আরেক সীমান্ত এলাকা কক্সবাজার থেকে। আর এসব মাদকের কারবার করে গোদাগাড়ীর অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আঙ্গুল ফুলে রাতারাতি হয়েছে কোটিপতি।

এখানকার একেকজন মাদক ব্যবসায়ী উত্থানের কাহিনী যেন কল্পনাকেও হার মানায়। বলা যায়, একেক জন যেন আলাদ্দিনের চেরাগ বাতি পেয়ে রাতারাতি কোটি কোটিপতি বনে গেছেন। কেউ বাসের সুপারভাইজার থেকে মাত্র ৮-৯ বছরের ব্যবধানে কোটিপতি, কেউ ডিম বিক্রেতা থেকে হয়েছেন কোটিপতি। আবার কেউ শুধুমাত্র দিনমজুর বা দোকানের কর্মচারী থেকে হয়েছেন কোটিপতি।

  • করেছেন গাড়ী, বাড়ি এবং অগাধ টাকা-পয়সা। তাদের কেউ এখন পুলিশের তালিকাভূক্ত ফেরারী মাদক ব্যবসায়ী আবার কেউ এখন গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। আবার কেউ এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশকে ম্যানেজ করে। আর এরই মধ্যে চলছে তাদের মাদক কারবার।

তাদের মধ্যে এমনই একজন হলেন গোদাগাড়ী উপজেলার মহিষালবাড়ী এলাকার শহিদুল ইসলাম ওরফে ভোদল। এই শহিদুল গত ২০০৪ সালেও ঝুড়িতে করে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন।

 

এরপর মহিশালবাড়ী গরুর হাটে করিডোরের কাগজ লিখে ২০ টাকা করে কমিশন নিয়ে দিন শেষে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আর আজ এক যুগ পরে শহীদুলের নাম এখন কোটিপতি। ডিম বিক্রেতা থেকে কোটিপতি শহিদুলের উত্থানের নেপত্থ্যের কারিগর হলো মাদক। যার নাম সর্বনাশা হেরোইন। এই সর্বনাশা হেরোইন বিক্রি করেই শহিদুল এখন কোটিপতি।

সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, শহিদুলের বাবা আফসার আলী ডাকু মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নকশি কাঁথা সেলাই করা সুতা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তাঁর ছেলে শহিদুলও বড় হয়ে বিয়ে সাদি করে সংসার চালাতে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করতেন ঝুড়িতে করে। আর আজ তিনি একটি তিন তলা আলিশান বাড়ি, একটি মাইক্রোবাস, রাজশাহী শহরের নওদাপাড়ায় দামি প্লট, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পেয়ারা বাগান, আম বাগান এবং একসঙ্গে ৭১ বিঘা জমির মালিক তিনি। যেন আলাদ্দিনের চেরাগ বাতির সেই রুপকথার গল্পকেও ছাড়িয়ে গেছে শহিদুলের উত্থানের কাছে।

পুলিশ, বিজিবি এবং মাদক দব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তর সূত্র মতে, ডিম বিক্রেতা থেকে শহিদুল ২০০৪ সালে কোরিডরের কাগজ লেখার কাজ যখন শুরু করেন, তখনই তিনি হেরোইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে প্রথম দিকে কয়েকবার তিনি শ্রমিক হিসেবে হেরোইন সরবরাহ করেছিলেন।

  • এরপর নিজেই জড়িয়ে পড়েন হেরোইন ব্যবসায়। সেই ব্যবসা করেই শহিদুল এখন কোটিপতি। অগাধ সম্পদের মালিক। যিনি বছর খানেক আগে নওগাঁয় একবার মাদক নিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তবে গোদাগাড়ী পুলিশের হাতে কখনো ধরা পড়েননি। এর কারণ হলো তিনি খুব কৌশলে থানা পুলিশের ঘোনিষ্ট হয়ে থেকে গেছেন। আর সেই সুযোগে হেরোইন ব্যবসা করে গড়ে তুলেছেন অগাধ সম্পদ আর অর্থ।

এই শহিদুলের সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মাদক ব্যবসা করেই শহিদুল এখন কোটিপতি। তার দাপটে এখানকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। তার উত্থান নিয়ে কেউ কিছু বললেই শহিদুল নানাভাবে ভয়ভীতি দেখায়।

  • তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শহিদুল বলেন, ‘আমি কখনো মাদক ব্যবসা করিনি। আমার বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়েছে। তাই পুলিশ আমাকে এখন সন্দেহ করে। আমার বাড়িতেও অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশের কারণে আমি বাড়িতেও থাকতে পারছি না।’ তাহলে এতো সম্পদ কিভাবে হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল বলেন, ‘পরিশ্রম করে করেছি। তাই মানুষ এখন হিংসা করছে।’

গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সির কাছে শহিদুল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ও পুলিশের তালিকাভূক্ত আসামি। তাকে আমরা খুঁজছি। কিন্তু সে এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে মামলা নাই। তাকে মাদকসহ হাতেনাতে কখনোই ধরা যায়নি। তবে সে অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী। তার উত্থানই প্রমাণ করে, সে মাদক সম্রাট। তাই পুলিশ তাকে খুঁজছে। তবে ধুরন্দুর শহিদুল এখন পুলিশের চোখে পলাতক।’

  • শহিদুলের মতো তার এক ভাতিজা আলমিনের উত্থানটিও হয়েছে একই কায়দায়। আলামিনের বাবা সেন্টু মিঞা মারা যাওয়ার পরে তার মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালাতেন। নিজেদের জমিজমাও কিছু ছিল না বললেই চলে। বাড়ির ভিটাই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। শহিদুলের ভাই সেন্টুর ছেলে সেই আলামিনও মাদক ব্যবসার বদৌন্নতে এখন দালান বাড়ি, গাড়ি, জমিসহ অঢেল সম্পদের মালিক। তবে আলামিন পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
  • গোদাগাড়ীর আরেক মাদক সম্রাট মাটিকাটা এলাকার সোহেল রানা এখন একটি নাশকতার মামলায় কারাগারে আছেন। মাদক কারবার করেই এই সোহেল বাসের সুপারভাইজার থেকে এখন কোটিপতি। গত ৫ মে এই শহিদুলকে মাদকের কারণেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে পরবর্তিতে একটি নাশকতার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

সোহেল সম্পর্কে গোদাগাড়ী গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত সোহেল গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী এটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তিনি মাদক ব্যবসা করেই কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। আর সেই টাকা এখন দেশবিরোধী ষঢ়যন্ত্রের পেছনে ব্যয় করছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। স্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজের অপকর্মের আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এ মাদক সম্রাট।’

  • গোদাগাড়ী থানা পুলিশ সূত্র মতে, মাদারপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সেতাবুর রহমান বাবু একসময় অন্যের জমিতে ট্রলিতে জমিচাষ করে সংসার চালাতেন। মাদকের কল্যাণে তিনিও এখন কোটিপতি।

বাবু সম্পর্কে গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, সে এখন পলাতক। পরিষদেও যাচ্ছে না। তার বাড়িতে আমরা অভিযান করেছি। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও ছিল।’
গোদাগাড়াীর আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হলেন, সিএ্যান্ডবি গড়ের মাঠ এলাকার মালা বক্স এর ছেলে হযরত আলী (৩৫)। এলাকায় জিনি জামায়াতের কর্মী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তার নেপথ্যের কারবার হলো হেরোইন ও ইয়াবা চোরাচালান। তিনি পাইকারি মাদক ব্যবসায়ী বলে মাদক স্বর্গরাজ্যে পরিচিত নাম। এর এভাবেই হযরত এখন কোটিপতি।

 

  • তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত মাদক সম্রাট। আগে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। কিন্তু এখন প্রায় ৭০ বিঘার আবাদি জমিসহ রাজশাহী নিউ মার্কেটে গার্মেন্টের মালিক এবং গড়ের মাঠে বিশাল বাড়িসগ গাড়ীর মালিক। তবে হযরত সম্প্রতি পলাতক রয়েছেন বলে দাবি করেছেন গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি।

এভাবে গোদাগাড়ী আরিজপুর গ্রামের তারেক ইকবাল, মাদারপুর এলাকার সবজি ব্যবসায়ী সেলিম তোফাজ্জল হোসেন, চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের মানিকচক গ্রামের শরিফুল ইসলাম, কোদালকাটি গ্রামের আব্দুল জাব্বার, মহিশালবাড়ী গ্রামের আজিজুল মায়ারী, মাদারপুরের নাজিবুর, চর আলাতুলি গ্রামের একধিক মাদক মামলার আসামি খুয়াজ তার ভাই হুমায়ন।

 

  • গোদাগাড়ীর হলের মোড় চাইপাড়ার লোকমান, মহিশালবাড়ী গ্রামের রাজমিস্ত্রী হেলাল, একই এলাকার টেম্পু চালক বাবু, মেকাইল, বিস্কুট ফেক্টরির কর্মচারি বানি ইসরাইল ওরফে ভোদোল, রাজমিস্ত্রী দেলাবুর পুলিশের তালিকাভূক্ত মাদক সম্রাট।

যারা একেকজন এলাকায় কোটিপতি নামে পরিচিত এখন। শুধু মাদকের সংস্পর্ষে এসেই তাদের কপাল খুলে গেছে মাত্র ১২-৫ বছরের মধ্যে। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে এখনো অনেকেই এলাকায় যাতায়াত রয়েছে। তবে কিছুটা হলেও পুলিশের চোখে আড়ালে।

  • নিয়মিত স্থানীয় পুলিশ এবং মাদক অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের মাসোহারা দিয়ে এই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখনো এমন অভিযোগও রয়েছে।

তবে এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা গোদাগাড়ীর মাদককে জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় সেটি করতে গিয়ে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আর ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো উপায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদকের নামে আর কাউকে সর্বনাশ করার সুযোগ দেওয়া হবে না।’

স/আর