টাকা যত কম, ব্রেন তত ভালো কাজ করে : আহসান চৌধুরী

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সংকটকালেও দেশের অন্যতম সেরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী।

তিনি বলেছেন, ‘এই ব্যবসায় গত ২৮ বছর ধরে কর্মরত আছি। যত টাকা কম থাকে, তত ক্রিয়েটিভিটি ভালো হয়। তাই আজকে বাংলাদেশে যদি সমস্যা বেশি থাকে, তাহলে দেখবেন যে আপনার মস্তিষ্ক ভালো কাজ করবে। যত টাকা কম, তত মাথার ব্রেন সেল কাজ করে। ভালো ভালো আইডিয়া হয়। যখন আমি দেখি আমার কোনো ক্রেডিট লাইন নেই, তখন কিন্তু আমার সমস্ত আইডিয়া আসে কীভাবে আমার বরোয়িংটা কন্ট্রোলে রেখে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারি। আমি এই ধরনের পলিসিগুলো ফলো করি।’

শনিবার (১১ জুলাই) রাতে অনলাইনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী। ওয়েবিনারের আয়োজন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিসিপ্লিন (এএবিএডি)।

সেখানে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের এফএমসিজি (ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস) সেক্টরে প্রথমদিকের মাসগুলোর জন্য করোনার প্রভাবটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। আমরা যখন করোনার মধ্যে প্রবেশ করি, দেখেছিলাম যে, খাদ্যপণ্যের দুইটা আইটেম-একটা অপরিহার্য, আরেকটি অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য পণ্যের চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়েছিল এবং প্রচুর পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছিলাম। অপরিহার্য নয়-এমন পণ্যগুলোর চাহিদা একটু কমেছিল। স্বভাবতই কৃষিপণ্যের চাহিদা বাংলাদেশে সবসময় ভালো ছিল। আমি মনে করি, করোনার প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য কৃষি ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে যখন প্রচুর পরিমাণে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ছিল, তখন কৃষকরা প্রচুর পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যখন লকডাউন উঠে গেল, তখনও কিন্তু আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের কৃষি। কৃষি আমাদের দেশকে অব্যাহতভাবে কৃষিপণ্য সরবরাহ করে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি মনে করেছি, এফএমসিজি সেক্টরে প্রথম দিকে পরিস্থিতি খারাপ থাকা সত্ত্বেও উত্তরোত্তর করোনার প্রভাব কেটে গেছে। আপনি জেনে খুশি হবেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি। আমি মনে করছি, এফএমসিজির চাহিদা উত্তরোত্তর ভালোই থাকবে।’

ahsan khan

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা রফতানির বাজারে কাজ করব, মান বজায় না রাখলে রফতানির বাজারে পৌঁছাতে সক্ষম হব না। যেহেতু আমরা নিয়মিত আমেরিকার বাজারে রফতানি করি, এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই তাদের সমস্ত মান মেনে রফতানি করতে হয়। আপনি জেনে খুশি হবেন, পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য পণ্যের গুণগতমান সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা রেখে আমাদের পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আছে, প্রত্যেক দেশের কিছু ফুড প্রসেসিংসের কিছু নর্মস (নিয়মনীতি) আছে। মান ঠিক রাখার কিছু নিয়মনীতি আছে। ওই নিয়মনীতি যদি মেনে চলি, তাহলে ওই দেশগুলোয় মানসম্মতভাবে পণ্য পৌঁছে দেয়া আমাদের জন্য কষ্টকর নয়। আমরা তাই করছি। কোনোরকম কোয়ালিটি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি না।’

‘আগামী দিনে চাকরির বাজারে কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে’-জানতে চাইলে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে এফএমসিজি সেক্টর কিন্তু আগামী দিনে ব্যাপকহারে গতিশীল হবে। বাংলাদেশে আগামী দিনে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। এফএমসিজি সেক্টরে আগামী দিনে যারা আসতে চাচ্ছেন বা যারা চিন্তা করছেন, এই সেক্টর ব্যাপক অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। রফতানি খাতেও বাংলাদেশ কিন্তু আগামী দিনে আরও ভালো করবে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের এফএমসিজি পণ্যগুলো পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে যাবে। এই ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু প্রয়োজন হবে বাংলাদেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম মানুষের। তাই বাংলাদেশের যারা দক্ষ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি আছেন, তারাও কিন্তু বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে যাবেন। আপনারা জেনে খুশি হবেন, ১৪০টিরও বেশি দেশে আমাদের প্রাণ-এর পণ্য রফতানি করছি। প্রতিটি দেশেই কিন্তু আমাদের প্রাণ-এর একজন প্রতিনিধি রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যাদেরকে পাঠিয়েছি ওই দেশগুলোতে। তারা কিন্তু প্রাণ-এর ব্যবসা কর্মকাণ্ডকে সেখানে প্রসারিত করছেন। আগামী দিনে এফএমসিজি সেক্টরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আগামীতে প্রফেশনালদের ব্যাপকভাবে এফএমসিজি সেক্টরে, রফতানি খাতে এবং স্থানীয় পর্যায়েও প্রয়োজন হবে। রফতানির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র একটি জায়গা ধরে আছে। আগামী দিনে রফতানিকে যদি বহুমুখী করি এবং আগামী দিনে রফতানি সেক্টরে মনোনিবেশ করেন, এফএমসিজি সেক্টরে যদি মনোনিবেশ করেন, তাহলে ব্যাপকভাবে আপনাদের চাকরির সুযোগ হতে পারে এবং আপনারা কিন্তু এগিয়ে যেতে পারেন।’

ahsan khan

তিনি বলেন, ‘করোনা এমন একটি জিনিস, যেটা পরিবর্তন করে দিয়েছে যে, স্কিল (দক্ষতা) বলে গতকালকে যেটা সঠিক ছিল, আজকে কিন্তু তা সঠিক নয়। প্রাণ-এর কোম্পানিতে আমরা কিন্তু ব্যাপকভাবে মানুষের ওপর ইঞ্জিনিয়ারিং ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। বিগত দিনে আমরা যারা অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে বসে কাজ করতাম, কিন্তু করোনা আমাদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে, এজন্য আমাদেরকে কেবল চার দেয়ালের মধ্যে বসে থেকে কাজ করলে হবে না। আমাদেরকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে যেতে হবে। যেখানে আমাদের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে, সেখানেই আমরা মেধা নিয়ে এগিয়ে যাব। আমি মনে করি, রফতানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। রফতানির মার্কেটিং খাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। স্যামসাং যদি পারে কোরিয়া থেকে এসে বাংলাদেশে পণ্য বিপণন করতে, তাহলে বাংলাদেশি করপোরেটরাও কিন্তু আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে সক্ষম হবে। কলকাতা ইউনিভার্সিটির বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গ্র্যাজুয়েটসরা যখন আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন, তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যখন কাজ করব, তখন বাংলাদেশ কিন্তু রিয়েলি ইন্টারন্যাশনাল হবে এবং ব্যাপকভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হব।’

আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে আসলে সম্ভাবনার কোনো শেষ নেই। এখানে ব্যবসা বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। সবসময় একটা হিসাব করে দেখতে হয়, আপনি ব্যবসাকে কতটুকু এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন। কতটুকু এগিয়ে নেয়া সম্ভব? আমাদের প্রাণ-আরএফএলে সবসময় কয়েকটা জিনিস ফলো করি। আমরা খুবই সেলস ফোকাস কোম্পানি। আমরা কিন্তু বাকির মধ্যে নেই। আমরা ক্যাশে বেচি এবং ক্যাশটাকে খুব তাড়াতাড়ি ঘরে আনতে চেষ্টা করি। আমরা সকলে বলি, আমরা এমপ্লয়-নির্ভর কোম্পানি না, মালিক-নির্ভর কোম্পানি। একজন দোকানদার জানেন কীভাবে তার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে হয়। আমাদের প্রাণ-আরএফএলের প্রত্যেকটি মানুষকে আমরা সেলসম্যান আকারে গড়ে তুলি। ফ্যাক্টরিতে যখন একটা মেশিন বসে, তারপর থেকে মেশিন থেকে কীভাবে আমরা উৎপাদন বের করতে পারি, এ বিষয়ে সবসময় আমাদের কাজ অব্যাহত থাকে। এই ব্যবসায় গত ২৮ বছর ধরে কর্মরত আছি। যত টাকা কম থাকে, তত ক্রিয়েটিভিটি ভালো হয়। তাই আজকে বাংলাদেশে যদি সমস্যা বেশি থাকে, তাহলে দেখবেন যে আপনার মস্তিষ্ক ভালো কাজ করবে। যত টাকা কম, তত মাথার ব্রেন সেল কাজ করে। ভালো ভালো আইডিয়া হয়। যখন আমি দেখি আমার কোনো ক্রেডিট লাইন নেই, তখন কিন্তু আমার সমস্ত আইডিয়া আসে কীভাবে আমার বরোয়িংটা কন্ট্রোলে রেখে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারি। আমি এই ধরনের পলিসিগুলো ফলো করি।’

বাংলাদেশে প্যাকেজিং ও বটলিং মেশিনারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ক্রোনসের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামানের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বাংলাদেশ চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়, মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের (জিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ( সিইও) ইয়াসির আজমান এবং মিটসুই অ্যান্ড কো (Mitsui & co) এর কান্ট্রি চেয়ারপারসন শরিফুল আলম।

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ