জেড সাম্রাজ্যের সম্রাট জান্তাপ্রধান

জেড অত্যন্ত মূল্যবান খনিজ পাথর। সারা বিশ্বে এ পাথরের প্রধান উৎসই হচ্ছে মিয়ানমার। আর এই জেড সাম্রাজ্যকে কুক্ষিগত করতেই জান্তাপ্রধানদের মনে চাড়া দিয়ে ওঠে ক্ষমতার মোহ। যার ফলাফল বারবারের অভ্যুত্থান। জান্তার গুটিকয়েক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলে এই জেড পাথরের ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই। সেই সঙ্গে এ মুহূর্তে নানামুখি নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন জেডই হয়ে উঠেছে জান্তাবাহিনীর তহবিল সংগ্রহের প্রধান উৎস। এসব বিবেচনায় মাল্টি-বিলিয়ন ডলার আয়ের এই উৎসে বিশ্ববাসীকে আঘাত হানতে পরামর্শ দিয়েছে গ্লোবাল উইটনেস। আন্তর্জাতিক অরাজনৈতিক এই এনজিওর সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় মঙ্গলবার।

শুধু জেডই নয়, চীনের সন্ধানী পাথর, রুবি ও অন্যান্য বিরল রত্নেরও অন্যতম উৎস মিয়ানমার। এই বিপুল রত্নভাণ্ডারকে কব্জা করাই জান্তাবাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য। আর এ কারণেই নানা অজুহাতে তারা দেশ শাসনের নামে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মূলত দখল নিচ্ছে ওই জেড সাম্রাজ্যেরই। ফলে ফুলেফেঁপে উঠেছেন জান্তাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তা। কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট অর্গানাইজেশন (কেআইও), দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি/ আর্মি(ইউডব্লিউএসপি/এ), আরাকান আর্মিসহ (এএ) আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীও স্থানভেদে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাদের গডফাদার হিসাবে কাজ করে সেনাবাহিনী। ২০২০ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদন বলছে ১৯৯০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ভাগাভাগি করেছেন দেশটির উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা। জেড সাম্রাজ্যের অন্যতম অংশীদার ছিলেন জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ২০১১ সালে তিনি একাই পেয়েছেন দুই লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।

ফরাসি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের এশিয়া ডিরেক্টর ফ্রাঙ্কয়েস নিকোলাস বলেন, ‘প্রায় অর্ধ শতাব্দীর শাসনামলে জান্তারা মূলত নিজেদেরই সমৃদ্ধ করেছেন।’ কিন্তু ২০১১-২১ সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি সু চি নেতৃত্বধীন বেসামরিক সরকার। তবে গত নভেম্বরে সু চির দল পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় সেনারা বুঝতে পারেন তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নিকোলাস বলেন, ‘সম্পদ বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার ফল হিসাবেই সম্ভবত তারা অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।’ অভ্যুত্থানের পরপরই জান্তারা রাষ্ট্রীয় সব কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।’ ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের দেবি স্টথার্ড জানান, ‘মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বিনিয়োগ এবং ব্যাংক হিসাব রয়েছে সিঙ্গাপুরে।’ তিনি বলেন, ‘এখনই উদ্যোগ না নিলে ওদের আর থামানো যাবে না। সম্পদ রক্ষার্থে তারা জনগণের ওপর আরও চড়াও হতে পারে এবং গণতন্ত্র ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। উল্লেখ্য, সামরিক জান্তার আয়ের উৎস হ্রাসের উদ্দেশ্যেই মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জেমস এন্টারপ্রাইজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। গ্লোবাল রিপোর্ট বলছে, জেড সাম্রাজ্যের আরেক অংশীদার ২০১১ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ক্ষমতা ভোগ করা জেনারেল থান শয়ের ছেলে। কিয়াং ইন্টারন্যাশনাল জেম্সের মাধ্যমে চুটিয়ে ব্যবসা করছে সে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই সাম্রাজ্যের অন্য অংশীদার হলেন জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের ছেলে অং পায়ে সোন। সে এখন মিয়ানমারের বিজনেস টাইকুন হিসাবে পরিচিত এবং তার বোন খিন থিরি থেট মোনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত।

২০১৬ সালে এনএলডি সরকার জেড ব্যবসায় কালোবাজারি বন্ধে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছিল, যেগুলোর মালিক ছিলেন ওই সেনা কর্মকর্তাদেরই কয়েকজন। ওই সময় সেনানিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড (এমইএইচএল) জেম্স ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাদের ১১০০ পারমিটের মধ্যে ৬৩৯টিই বাতিল করেছিল সু চি সরকার। গ্লোবাল রিপোর্ট ধারণা করছে, তার ফলই হয়তো সু চি ভোগ করেছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি। কারণ জেড মাইন তাদের নিয়ন্ত্রণে চাই-ই চাই। ক্ষমতা ফিরে আবার তারা ভোগ করতে শুরু করেছে জেড সাম্রাজ্যের যাবতীয় সম্পদ। এমইএইচএলের পাশাপাশি এই ব্যবসায় জড়িত রয়েছে মিয়ানমার রুবি এন্টারপ্রাইজ, মিয়ানমার ইম্পেরিয়াল জেড কোম্পানি লিমিটেড এবং ক্যাংক্রি কোম্পানি লিমিটেড। এগুলোর মধ্যে তিনটি কোম্পানিকে নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

সূত্রঃ যুগান্তর