‘জীবিকার কাছে জীবন অসহায়’

শাহিনুল আশিক:


বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ছুটছেন মানুষ। হঠাৎ করে রাজধানীতে গার্মেন্টস শিল্প কারখানা চালুর ঘোষণায় সড়কে বেড়েছে এমন ভোগান্তি। সারাদেশের মতোই রাজশাহী থেকেও ট্রাক, বাসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মস্থলের পথে ছুটেছেন কর্মজীবীরা মানুষ।

রোববার (১ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী শিরোইল ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়- কর্মজীবি মানুষের ভিড়। এই বাসস্ট্যান্ডে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ ঢাকা যাওয়া উদ্দেশ্যে এসেছেন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলোতে পাশা-পাশি বসে যাত্রীদের আসতে দেখে গেছে।

বিষয়টি নিয়ে পরিবহন সংশ্লিস্টরা মন্তব্য করতে নারাজ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলছেন- ‘অসুবিধা নেই। অনেকেই একই পরিবারের।’ অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন- ‘নিজে গিয়ে দেখতে হবে।’ বাসে উঠে দেখে যায়- যাত্রীরা পাশা-পাশি বসে আছেন। কারো মুখে মাস্ক থাকলে অনেকেই নিচে নামানো ছিলো। এছাড়া সংবাদ কর্মীদের দেখে অনেকেই মাস্ক পড়েছেন।


ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ফেরা


কর্মস্থলে ফিরতে কাউন্টারের যাত্রীরা।

এমন কথার উত্তরে রাকিবুল ইসলাম নামের এক যুবক জানান, ‘দেশে (তানোরে) কৃষি কাজ ছাড়া, কাজ নেই। গার্মেন্টসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। সেখানে আমার স্ত্রীও কাজ করে। দুজনের উপার্জনে ভালই চলে সংসার। গ্রামে তো দুজনের কাজ করতে পারবো না।’

তিনি বলেন-দীর্ঘদিন থেকে বাড়িতে বসে আছি। টাকা পয়সাও শেষ পর্যায়ে। বাড়ি থাকলে শুধু খরচ। কাজে গেলে খরচ নেই। ৫ আগস্ট লকডাউন শেষ হবে। যদি আবার বাড়ায় তাহলে এই সমস্যা থেকে যাবে। তখন আরও কষ্ট করেই যেতে হবে। গার্মেন্টস থেকে এসএমএস দিয়েছে কাজে যোগ দিতে হবে। আমি (রাকিবুল) মনে করে কাজে যোগ না দিলে সমস্যা হবে। কাজ চলে যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন- দেখেন আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। চাইলেই পারবো না একটা মাইক্রো ভাড়া করে ঢাকায় যেতে। সেখানে অনেক টাকা খরচ হবে। সেই টাকায় আমাদের খাওয়া ও ঘর ভাড়ার টাকা হযে যাবে। করোনার এমন পরিস্থিতেতে রাজশাহীর অবস্থাও ভালো না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজের মধ্যে থাকতে পারলে টাকা উপার্জন হবে। নিজেও পরিবার নিয়ে ভালো থাকবো।’


 যাতায়াতে করোনায় সংক্রম ঝুঁকি


বিষয়টি নিয়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘করোনা দেশের সব জায়গায় আছে। লকডাউনের পরে গেলে (ঢাকায়) কি করোনা হবে না? এমন কথার ভিত্তি আছে? -নাই। কারণ সচেতনা নিজের মধ্যে। আমি (সাইফুল) বাড়ি থেকে বের হয়ে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে একবারের জন্য নাকে মুখে হাত দিতে দেয়নি। এছাড়া মাস্ক খুলিনি। তাহলে আমি কিভাবে সংক্রমিত হতো? বলেন।

আপনি ও আপনার স্ত্রী এক সাথে বসে আছেন মেয়েকে নিয়ে, আপনার ছেলে অন্য যাত্রীর সাথে বসে আছে- তাহলে সে তো করোনায় আক্রান্ত হতে পারে এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন- ‘আক্রান্ত হলে দেখে যাবে। ঢাকা হাসপাতলে ভর্তি করে দেবো। উপাই নেই কাজে জেতেই হবে।’

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর অনেক চাপা, চিকিৎসা ছাড়াও নানান খরচের মধ্যে পড়ে যাবেন, এমন নয়কি? এ কথার উত্তরে তিনি জানান, ‘বাড়িতে এসে কোরবানি দিয়েছি। সেখানে ১৭ হাজার টাকা গেছে। কেনা-কাটা নিয়ে আরও ১০ হাজার টাকা গেছে। আমরা দিনমজুর। আমাদের কাছে কতই বা টাকা থাকে। হাজার দশেক টাকা আছে। ঢাকায় ফিরে বাসা ভাড়া দেব। সহকর্মীকে বলেছি ৫ হাজার টাকা ধার দিতে। সেই টাকায় খাবারের ব্যবস্থা হবে। রাজশাহীতে থাকলে শুধু খরচ হবে। ঢাকায় গেলে খরচও হবে উপার্জনও হবে। তাহলে আমার কাছে কাজে ফিরে যাওয়া টাই উত্তম।’


অসুস্থ্য কর্মীর কর্মস্থলে ফেরা


নাম সাবেকুন নাহার। বেশ কয়েকদিন থেকে জ্বরে ভুগছেন। রয়েছে কাশিও। তিনি জানান, আমরা দুই মানুষ (স্বামী-স্ত্রী) একই জায়গায় কাজ করি। অফিসে বলেছি, আমার জ্বর। তারা বলেছে- ওষুধ খান। আর কাজে যোগ দেন। আজ (রোববার) মোটামোটি সুস্থ্য, তবে কাশি রয়েছে।

তিনি আরও জানান, ঢাকায় যাওয়ার পরে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে বাড়িতে রেস্ট নেব। তখন ছুটি নেওয়া যাবে। কিন্তু এখন কাজে না গেলে সমস্যা হবে।


রাজশাহীর সড়কে যানবাহন বেড়েছে


সড়কে বেড়েছে রিক্সা ও অটোরিক্সার উপস্থিতি

গত কয়েক দিনের তুলনায় রাজশাহী নগরীর সড়কে যানবাহন বেড়েছে। গতকাল শনিবারের তুলনায় আজ রোববার দ্বিগুণ অটোরিক্সা-রিক্সা সড়কে লক্ষ্য করা গেছে। তবে কাটাখালী, বিনোদপুর, তালাইমারী, বাজারের চলাচল করা অটোরিক্সা ও রিক্সায়  যাত্রীর সংখ্যা কম ছিলো।

অন্যদিকে, কাশিয়াডাঙ্গা, আমচত্বরে এলাকার দিকে থেকে শহরে আসা অটোরিক্সা ও রিক্সাগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিলো। কারণে এই যাত্রীরা রাজধানীতে গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানায় কাজ করেন। তারা বাস চালুর ঘোষণায় ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন।

শহিদ নামের একজন অটোরিক্সা চালককে জিজ্ঞাসা করা হয় লকডাউন কি উঠে গেছে? এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন- জানি না ভাই। তবে কাল ঘোষণা শুনেছি বাস চলবে। তাই আমরাও অটোরিক্সা নিয়ে বের হয়েছি। আর কতদিন বাড়িতে বসে থাকবো।

একই অটোর যাত্রী রায়হান জানান, গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানা খুলেছে। তার মানে গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানায় কাজ হবে। সেখানে কাজ করতে হলে আমাদের যেতেই হবে। না হলে চাকরি থাকবে না। আজকের পরে গেলে বেশি ভাড়া লেগে যাবে। আর বাসে গেলে তুলনামূলক কম ভাড়ায় যাওয়া সম্ভব।


বাস চালক ও সুপারভাইজার:


দীর্ঘদিন বাস বন্ধ থাকায় জীবন-জীবিকা নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। গাড়ি চাকা না ঘোরায় তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন। মাত্র ১৬ ঘন্টার বাস চলেচলে তাদের উপার্জনের দুয়ার খুলেছে। অল্প সময়ে ঢাকা একটি ট্রিপ যেতে পারলে তাদেরও উপার্জন হবে কিছু টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা একতা পরিবহনের একজন চালক জানান, ‘চেষ্টা চলছে স্বাস্থ্যবিধি মানার। তবে সম্ভব হয় না।’

ঢাকায় যাওয়া একটি বাসের সুপারভাইজার জানান, ‘ঢাকায় একজন যাত্রী তারা নিয়ে যাচ্ছেন ৭০০ টাকা ভাড়ায়। সিটে বসার বিষয়ে তিনি জানান- পাশা-পাশি বসছে। একটা দিনই তো।’

বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক টিটো জানান- ‘অল্প পরিষরে বাস ঢাকা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হচ্ছে। রাজশাহী থেকে ১০টির মতো বাস গেছে ঢাকায়। এখনও (১ টা বেজে ৫১ মিনিট) দুই একটি বাস রাস্তায় আছে তারা দ্রুতই ফিরবে।

তিনি আরও জানান, বেশির ভাগ মানুষ সকালের দিকে ট্রাকসহ বিভিন্ন ভাবে ঢাকায় গেছে। যেই সময় বাস চলাচলের ঘোষণা আসলে তখন যাত্রীর অভাব। তার পরেও অল্প যাত্রী নিয়ে ঢাকায় গেছে রাজশাহীর কিছু বাস।


বাস বন্ধের দিনে কাউন্টারের চিত্র

পুলিশ বলছে


রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম জানান- গার্মেন্টস শিল্প কারখানা চালুর ঘোষণায় কর্মীরা অটোরিক্সা ও রিক্সায় বাস স্ট্যান্ডে আসছেন। মূলত এই কারণে সড়কে দেখা গেছে। এছাড়া কিছু বাস যানজটে আটকা পড়তে পারে, সেগুলো ফিরছে বাসস্ট্যান্ডে।’

প্রসঙ্গত, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে সব ধরনের গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শনিবার (৩১ জুলাই) রাতে সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে ১ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

স/আ