সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটবাহিনী এবং রাশিয়ার ধারাবাহিক বিমান হামলায় বিপর্যস্ত জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) সিরিয়া ও ইরাকে তাদের দখলে থাকা কতোটা এলাকার হারিয়েছে, তার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে বিবিসি।
সিরিয়ার কোবানে, মানবিজ ও পালমিরার মত গুরুত্বপূর্ণ শহর আইএস এর হাতছাড়া হয়ে গেছে; আলেপ্পো এবং ইরাকের মুসলে চলছে জোর লড়াই।
আইএস এর কথিত ‘খিলাফতে’র মধ্যে থাকা এক চতুর্থাংশ জায়গা গত দেড়বছরে তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে গত জুলাইয়ে এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে আইএইচএস কনফ্লিট মনিটার, যারা সিরিয়া ও ইরাকের যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে আসছে।
আইএইচএস এর বিশ্লেষকরা মানচিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক কোটি জন অধ্যুষিত এলাকা আইএসের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, এখন তা ৬০ লাখে নেমে এসেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ‘নৈরাজ্য’ ও ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের’ সুযোগে সেখানে মাথাচাড়া দিয়েছিল আইএস।
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/is-map-2015.jpg/ALTERNATES/w640/IS-MAP-2015.jpg)
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/is-map-2016.jpg/ALTERNATES/w640/IS-MAP-2016.jpg)
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকে হামলা চালানোর পর সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার ভেতরেই বেড়ে উঠে আইএস। এরপর দেশটির ভেতর অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগানো শুরু করে তারা।
২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদবিরোধী একটি অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর মধ্য দিয়ে তারা এটি বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সিরিয়ায় একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পায়।
একই সময়ে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী প্রত্যাহার করলে দেশটির শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সুন্নি জনগোষ্ঠীর তীব্র রোষ আইএসকে সুযোগ করে দেয়।
২০১৩ সালে তারা সিরিয়ার একটি বিরাট অংশ দখলে নেয়; তারপর নিজেদের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত (সিরিয়া)’। সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় আইএসআইএস বা আইএসআইএল।
পরের বছর উত্তর ইরাকের মসুল শহর কব্জা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি কাড়ে আইএস। উত্তর ও পশ্চিম ইরাকের বিরাট অংশ দখলে নেওয়ার পর ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি।
ওই বছরই বাগদাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে ইরাকি কুর্দিশ সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় আইএস; ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোককে হত্যা করে, তাদের নারীদেরকে বানায় দাসী। এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটি আতঙ্কের রূপ নেয় আইএস।
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/coalition-strike.jpg/ALTERNATES/w640/COALITION-STRIKE.jpg)
২০১৪ সালের অগাস্টে জঙ্গি এ গোষ্ঠীর উপর বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র; তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় বহুজাতিক জোট। ইরাকে এ জোট অন্তত নয় হাজার ৬০০ বার বিমান হামলা চালিয়েছে, সিরিয়ায় চালিয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি বার।
আইএসবিরোধী এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়েছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জর্ডান, নেদারল্যান্ড, বাহরাইন, সৌদি আরব, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
রাশিয়া এ জোটের সদস্য নয়, তবে মিত্র আসাদের পক্ষে মস্কোও ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হয়।
২০১৪ সালে জানুয়ারি থেকে আইএসের হাতে কেবল ইরাকেরই ২৩ হাজার সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান বলে জাতিসংঘের তথ্য।
সিরিয়ায় তাদের ধ্বংসযজ্ঞের পুরো খতিয়ান জাতিসংঘের হাতে নেই। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ সিরিয়ান অবজারভেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের মার্চ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহুপক্ষীয় সংঘর্ষে দেশটিতে অন্তত তিন লাখ লোক মারা পড়েছে, যার মধ্যে ৮৬ হাজার বেসামরিক নাগরিক।
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/palmira-2015.jpg/ALTERNATES/w640/PALMIRA-2015.jpg)
সিরিয়ার পালমিরা, আইএস এর ধ্বংসযজ্ঞের আগে (উপরে) ও পরে
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/palmira-2.jpg/ALTERNATES/w640/PALMIRA-2.jpg)
২০১৪ সালের জুনের দিকে আইএসের ‘খিলাফত’ কিছুটা থমকে যায়। এরপর ইরাক ও সিরিয়ার বাইরেও হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
আইএইচএস এর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিম জঙ্গিরা আইএস নেতা বাগদাদির প্রতি সমর্থন জানায়। ২০১৬ সালে আইএস তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ হামলা চালায়; যাতে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।
ধারণা করা হয়, ১৮টি দেশে সদস্য সংগ্রহ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে আইএস; এর মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার বাংলাদেশ, মালি, সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিন্সে আইএসের ‘সম্ভাব্য শাখা’র অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার বরাবরই দেশের ভেতরে আইএসের অস্তিত্ব থাকার কথা নাকচ করে আসছে।
কেবল ইরাক ও সিরিয়ার যোদ্ধারা নয়, এর বাইরে ৮৬টি দেশের অন্তত ২৭ হাজার বিদেশি যোদ্ধা আইএসের হয়ে লড়ছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সৌফান গ্রুপ। এসব যোদ্ধার অর্ধেকেরও বেশি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে।
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/is-revenue.jpg/ALTERNATES/w640/IS-REVENUE.jpg)
কালো বাজারে তেল বেচে পাওয়া অর্থই আইএসের খিলাফত ও যুদ্ধ পরিচালনার প্রাথমিক উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। ২০১৩ সালের শুরু থেকেই গোষ্ঠীটি ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি তেলের খনি নিজেদের কব্জায় নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর তাদের তেল অবকাঠামোর বিরাট ক্ষতি হয়।
সেন্টার ফর দ্য অ্যানালিস্ট অব টেররিজম (সিএটি) এর ধারণা, খনি থেকে দ্রুত ও বেশি পরিমাণ তেল উত্তোলনের পর সেগুলোর সংস্কার ও তেল শোধনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আই এস এর হাতে নাই।
এর বাইরে গতবছর ‘চাঁদাবাজি’ থেকে আয়ের ৩৩ শতাংশ তুলে আনে আইএস। চাঁদার এই অর্থ আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি বলে সিএটির তথ্য।
দখল করা এলাকায় পানি ও বিদ্যুৎ বিল, উৎপাদিত পণ্যের উপর কর থেকেও আইএস আয় করে। দখলি এলাকার পরিমাণ একে একে হাতছাড়া হতে থাকায় এ আয়ের পরিমাণও কমছে, জানিয়েছে আইএইচএস কনফ্লিক্ট মনিটর।
গত জুলাই মাসে হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থের অভাবে আইএস এখন যুদ্ধ পরিচালনাতেও সমস্যায় পড়েছে।
![](http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/09/23/is-refugee.jpg/ALTERNATES/w640/IS-Refugee.jpg)
আইএসের আক্রমণ ও তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় জনশূন্য হয়ে গেছে সিরিয়া ও ইরাকের অনেকগুলো শহর-গ্রাম। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী কেবল সিরিয়া থেকেই ৪৮ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল প্রতিবেশী তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডান।
২০১৫ থেকে শরণার্থীদের এই স্রোত ইউরোপের দিকে ধাবিত হয়। সিরিয়ার শরণার্থীদের চাপ সামলাতে পরে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে শরণার্থীদের তুরস্কে রাখার বিনিময়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় ইইউ।
যুদ্ধে ৩০ লাখ ইরাকিও বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। মসুলে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ সংখ্যা আরও ১০ লাখ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা এই বিশ্ব সংস্থার।
সূত্র: বিডি নিউজ