মোহনপুরে ২০টি পরিবারের বিশাল কর্মযোগ্য

চুন বিক্রিতে বছরে দেড় কোটি টাকা আয়

শাহিনুল আশিক:


বংশ পরমপরা থেকে চলছে পান খাওয়ার চুন তৈরি ও বিক্রির কাজ। প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন- মোহনপুরের চাঁদপুর রণপাড়ার প্রায় ২০টি পরিবার। ছোট্টগ্রামটির ওই পরিবারের সদস্যরা চুন তৈরির কাজ করেন। ওই চুন রাজশাহী ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করে। এই কাজে আগের তুলনায় জীবন-জীবিকা ভালো চলছে বলে জানান তারা।

চুন তৈরির সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামের ২০টি পরিবারের মধ্যে ১৫টিতে প্রতিদিন চুন তৈরি করা হয়। বাকি ৫টি পরিবারে সপ্তায় তিন থেকে চারদিন চুন তৈরি হয়। একটি বাড়িতে দিনে ১০০ থেকে ১২০ কেজি চুন তৈরি হয়। দিনে কমপক্ষে ১০০ কেজি চুন তৈরি হলে ১৫টি বাড়িতে প্রতিদিন ১৫শো কেজি চুন তৈরি হয়। মাসের হিসেবে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার কেজি অর্থাৎ ৪৫ মেট্রিক টন। ৩০ টাকা কেজি দরে চুন বিক্রি হয়। সে হিসেবে মাসে চুন বিক্রি দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর এক বছরের হিসেবে চুন বিক্রি দাঁড়ায়Ñ ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা।



সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুন তৈরি তাদের দাদার পেশা ছিল। দাদা গত হওয়ার পরে বাবা করেছে এই কাজ। অনেকের বাবাও গত হয়েছে, তাই সন্তানরা চুন তৈরির কাজে লেগেছেন। চুন তৈরি পুরানো একটি পেশা। তারা জানান, ৪০ বছর আগে অল্প কয়েকটি পরিবার চুন তৈরি করতেন এ গ্রামে। এখন ওই পরিবারগুলো ছাড়াও অন্যরাও এসেছে এই পেশায়। তাই এখন সংখ্যায় বেড়েছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে- চুন তৈরিতে শুধু শঙ্খ (ঝিনুক) কিনতে হয়। টিউবয়েলের পানি ছাড়া আর কিছু লাগে না। শঙ্খ আর পানির মিশ্রণে তৈরি হওয়া চুনে লাভের অঙ্ক কয়েকগুন। তাই বের হতে চান না এই পেশা থেকে অনেকেই।

সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে বাড়িতে চলছে চুন তৈরির কর্মযোগ্য। বাড়ির ছেলেদের পাশাপাশি নারীরাও সাহায্য করে এই কাজে। চুন তৈরির আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় নিজেদেরই করতে হয় এই কাজ। ফলে একার পক্ষে চুন তৈরির কাজ সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই পরিবারের নারীরাও এই কাজে পুরুষদের সাহায্য করে থাকেন। কেউ কেউ শ্রমিক খাটায় চুন তৈরির কাজে।

৭০ বছর বয়সের তৌফিল উদ্দিন। চুন তৈরি করে বিক্রি করেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিনও চুনের ব্যবসা করতেন। এখন ছেলে জীবন আলী এই পেশার হাল ধরেছেন।
তৌফিল উদ্দিনের ছেলে জীবন আলী জানান, ‘বাবা-মাকে বলতে শুনেছি দাদাও চুন তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা করতেন। দাদা মারা যাওয়ার পরে ব্যবসার হাল ধরেছেন বাবা। বাবাও দীর্ঘদিন থেকে চুন তৈরির কাজ করছেন। জীবন জানায়, বাবার বয়স হয়েছে- এখন চুন তৈরির শঙ্খ কিনে আনা থেকে শুরু করে সব কাজ তাকে করতে হয়। এই কাজে একজন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করে।

জীবন আলী জানান, চাঁপাইনব্বগঞ্জ, গোদাগাড়ী, রাজাবাড়ি, তানোর, রাজশাহী শহর, নওহাটা, কাটাখালী, বানেশ্বর, চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়ায় চুন বিক্রি করেন তারা।

মোজাফফর হোসেন জানালেন- চুন তৈরির মূল উপাদান শঙ্খ। শঙ্খ কিনতে হয় বগুড়া থেকে। বগুড়ার ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম থেকে শঙ্খ কিনে আনেন। এর পরে তারা চুল্লিতে পুড়িয়ে শঙ্খগুলো বস্তাবন্দি করে বিক্রি করে। বগুড়ার ব্যবসায়ীরা শঙ্খ বিক্রি করে ২ হাজার থেকে ২২০০ টাকা মণ দরে। অর্ডার অনুযায়ী বগুড়া থেকে রাজশাহীর মোহনপুরের কেশরহাটে প্রতি সপ্তায় দুইদিন শনিবার ও বুধবার ট্রাকে শঙ্খ পাঠায় তারা।

তিনি আরো জানান, ১০ কেজি শঙ্খ প্রক্রিয়াজাত করে চুন তৈরি হয় ৮০ কেজি। এক মণ শঙ্খ দিয়ে ৩২০ কেজি চুন তৈরি হয়। ৩০ টাকা কেজি দরে চুন বিক্রি করলে এক মণের দাম লাগে ৯ হাজার ৬০০ টাকা। তাহলে ২ হাজার টাকার শঙ্খ দিয়ে ৯ হাজার ৬০০ টাকার চুন তৈরি হয়।

চুন তৈরির শ্রমিক রাজিব ইসলাম জানান, ‘১০০ কেজি চুন তৈরি করতে সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। একাজে একজন শ্রমিক প্রতিদিন মজুরি পান ৩০০ টাকা। একজন শ্রমিক ১২ থেকে ১৩ কেজি শঙ্খ প্রক্রিয়াজাত করে ১০০ কেজি চুন তৈরি করে। তবে চুন তৈরিতে শঙ্খ আর ঠান্ডা পানি ছাড়া কিছু লাগে না। দীর্ঘক্ষণ শঙ্খ একটি তাওয়ার (মাটির তৈরি গরুকে খাবার দেওয়ার চাড়ি) মধ্যে ঘুটতে হয় (নাড়াচাড়া করা)। এর পরে একবারে মিহি (মিশ্রণ) হয়ে গেলে চুন তৈরি হয়ে যায়।’

৫০ বছর বয়সী নারী চম্পা বেগম জানান, ‘আামার দাদাও চুনের ব্যবসা করেছেন। তবে কেশরহাট থেকে গোটা চুন কিনে বাড়িতে তৈরি করতেন। তার পরে রাজশাহী শহরে বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন তিনি। আমার বাবা ওয়াজউদ্দিন, ভাই ওহাব, মুক্তার ও মঞ্জু বাড়িতে চুন তৈরি করে বিক্রি করেন। চুন তৈরির পরে বিক্রি আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসছে।’

দীর্ঘদিন চুন তৈরির ফলে শারীরিক সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান,‘ না শারীরিক সমস্যার কথা শুনিনি। চুন তৈরির সময় হাতে লেগে যায়। এতে হাতে চর্ম রোগ বা অন্য কোনো রোগের কথা শুনিনি, দাদা-বাবা ও ভাইদেরও হয়নি।’

চুন তৈরি করা মোজাফফর হোসেন আরো জানান, তার বাবা মৃত আনোয়ার হোসেনও চুন তৈরি করে বিক্রি করতেন। নিজ বাড়িতে বাবার চুন তৈরি করা দেখে শিখেছেন তিনি। বাবা গত হওয়ার পরে চুন তৈরির কাজ তিনি নিজেই করেন। কোনো কোনো সময় ছেলে ও স্ত্রীও তাকে সাহায্য করে।

মোজাফফর জানান, ৩২ বছর ধরে তিনি চুন তৈরি করেন। দীর্ঘ ৭০ থেকে ৭৫ বছর এই কাজ করেছেন বাবা। চুন তৈরি ও বিক্রি করে চলে আমার সংসার। মানুষের কাজে যেতে হয় না আমাকে ও ছেলেকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. বেলায়েত হোসেন হাওলাদার জানান, ‘চুনে ক্যালসিয়াম ও অক্সাইড থাকে। এতে তেমন ক্ষতি হয় না। তবে বেশি খেলে মুখ পুড়ে যায়। তবে চুনের থেকে পানের ভেতরে সাদাপাতা, জর্দ্দা, খয়ের খাওয়া হয় সেগুলো ক্ষতি কর।’

স/আ