‘চাঁদাবাজ’ আকবরের পদে এসআই ‘জুয়াড়ি শাহিন’, পরে ‘বদলি’

সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় বরখাস্ত হওয়া ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরের স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক এসআই শাহিন মিয়াকে। কিন্তু জুয়া, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এই এসআই। সিলেট মহানগর পুলিশে (এসএমপি) কর্মরত পুলিশ সদস্যরা তাকে ‘জুয়াড়ি শাহিন’ নামে চিনেন। তার জুয়া খেলার ভিডিও রয়েছে যুগান্তরের হাতে। এসএমপি বড়কর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় শাহিনের বিরুদ্ধে কখনও বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

 

সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র ‘সিটি পয়েন্ট’ এর একপাশে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়। অপর পাশে কুদরত উল্লাহ মার্কেট ও মসজিদের মাঝে টিন শেডের বাসায় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। গুরুত্বপূর্ণ ফাঁড়িতে নতুন করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আরেক বির্তকিত পুলিশ কর্মকর্তা এসআই মো. শাহিন মিয়াকে। তিনিও আকবরের মতো কনেস্টবল থেকে এসআই হয়েছেন।

শাহিন মিয়া নিয়ে বির্তকের শেষ নেই। জুয়া, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে তার এসব কর্মকা­ণ্ড নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। তখন লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন তিনি। তারপর কর্তৃপক্ষ তাকে ক্লোজড করে নেয় কোতোয়ালী থানায়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পুনরায় এসএমপির দক্ষিণ সুরমা থানার কদমতলী বাস টার্মিনাল ফাঁড়িতে বদলি নেন শাহিন। সেখানেই নগদ টাকার উর্বরতা। দু’হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়ে কুমির বনে গেছেন তিনি। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স সবই আছে তার। সেকারণে ফাঁড়ি থেকে ফাঁড়িতেই রাজত্ব করছেন অনায়াসে।

দীর্ঘ এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে বদলি হন নগরীর শাহপরান থানায়। দায়িত্ব নেন উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির। কিন্তু থানার ওসির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পুনরায় বদলি হয়ে যান এসএমপির মোগলাবাজার থানাতে। সেখানেও ঘুরে ফিরে দায়িত্বে নেন আলমপুর পুলিশ ফাঁড়ির। এর ৫-৬দিন পরই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের ফলে নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার মূলহোতা ছিলেন ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর। যিনি বরখাস্ত হয়ে পলাতক রয়েছেন।

সেই সুযোগে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে জায়গা করে নেন শাহিন। গত বুধবার বিকালে তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্ব দেয় এসএমপি পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে এসআই শাহিন মিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এদিকে এসব অভিযোগ ওঠার পর বৃহস্পতিবার রাতেই তার যোগদানপত্র বাতিল করে বিমানবন্দর থানায় বদলি করা হয়েছে বলে এসএমপির একটি সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তার বিরুদ্ধে কয়েকবার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে শাস্তিতো হয়নি বরং প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছে শাহিন। জুয়া খেলার ভিডিও কিংবা ছবি কিছুই আমলে নেননি কর্মকর্তারা।

তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় এসএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের কিছুটা লুকোচুরি করেন। তিনি বলেন, শাহিনকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নাকি শাহিনকে দায়িত্বই দেয়া হয়নি। বিষয়টি অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ হিসেব এখনও কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এসআই শাহিনকে বিমানবন্দর থানায় বদলি করা হয়েছে।

এসআই শাহিনের দায়িত্ব পালন ও তার পূর্বের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয় আমরা জেনেছি। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১০ অক্টোবর রাতে মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য বন্দর ফাঁড়িতে নির্যাতন করে রায়হান নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার মূলহোতা বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন। আকবরের নেতৃত্বে এই অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ ঘটনায় আকবরসহ ৪ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর আকবর পালিয়েছেন।

২০০৭ সালে কনস্টেবল পদে পুলিশে যোগ দেন আকবর হোসেন। ২০১৪ সালে হন পুলিশের এসআই। পুলিশে যোগদান করার পরইবদলে যায় আকবর হোসেন ভূঁইয়া ও তার পরিবারের অবস্থা।

জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলা বগইর গ্রামে জাফর আলী ভূঁইয়ার বড় ছেলে পুলিশের এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সবার বড় বোন। পুলিশে তার চাকরি হওয়ার পর বদলে যায় তার পুরো পরিবারের অবস্থা। এক ভাইকে প্রবাসে পাঠিয়েছেন। অন্য ভাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন তিনি। বোনদের বিয়েও দিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে এখন নির্মাণ করেছেন বিলাসবহল দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। প্রথম তলার কাজ ইতোমধ্যে শেষ করেছেন।

পাশাপাশি বাড়ির সামনে নির্মাণ করছেন আধুনিক একটি গেট। যার নির্মাণ কাজ এখন চলছে। তার বাড়ির আশপাশে রয়েছে তাদের নামে-বেনামে অঢেল সম্পত্তি। আর সব কিছু হয়েছে পুলিশের কর্মকর্তা আকবর হোসেন ভূঁইয়ার বদৌলতে।

সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হান নামে যুবককে নির্যাতন করে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা আকবর হোসেন ভূঁইয়া জড়িত থাকায় হতবাক তার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মানুষ। তারা বলছেন, পুলিশ কর্মকর্তা আকবর হোসেন ভূঁইয়া ও তার পুরো পরিবার বিতর্কিত। তার পিতা জাফর আলী ভূঁইয়া স্কুলছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামি ছিলেন। জেলও খেটেছেন এক মাস।

বিএনপি আমলে ওই পরিবারের ছিল একক আধিপত্য। সময়ের সঙ্গে তারা এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন জড়িত। অভিযোগ আছে, টাকার বিনিময়ে তিনি পুলিশে চাকরি নিয়েছিলেন। পুলিশের চাকরিতে যোগদান করে হয়েছেন অগাধ সম্পত্তির মালিক।

অভিযোগ রয়েছে- ছিনতাইকারী চক্র, হকার, অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত আবাসিক হোটেল থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন এই আকবর। এছাড়াও জুয়া ও মাদকের স্পট থেকে সাপ্তাহিক একটা অংকের চাঁদা নিতেন তিনি।

জানা গেছে, প্রত্যেক রাতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আকবরের জন্য টাকা আদায় করতে হতো। আকবরের চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এক এসআই উপায় না পেয়ে গত জুলাই মাসে অন্যত্র বদলি হয়ে যান।

 

সূত্রঃ যুগান্তর