চর খিদিরপুরে গেলে ‘বুক ফ্যাটি’ যায় জাকারুল মাঝির

শাহিনুল আশিক:


‘নদী ভাঙ্গন শেষ করলো সব। বিঘা-বিঘা জমি নদী গিলেছে (গর্ভে)। ২৫ বিঘার উপরে জমি ছিলো আমাহারে (আমাদের)। এখন কিছুই নাই। সব নদীতে তলা (তলিয়ে) গেছে। এখন মানুষের জমি-লি (নিয়ে) চাষবাস (চাষাবাদ) করি। আর এই নৌকাই সম্বল। নৌকাতে মানুষের আবাদ-পানি (জমির ফসল) টানি। মাছও মারি (ধরি)। যা হয় তাতে পেট (সংসার) চলে।’

রাজশাহী নগরীর মিজানের মোড়ের জাহাজঘাট এলাকায় নিজের পুরানো নৌকা মেরামতের কাজ করছিলেন ৫৫ বছর বয়সের মাঝি জাকারুল ইসলাম। শ্রমিক নৌকাটি সংস্কার করেছে। এখন চলছে নৌকায় আলকাতরা লাগানোর কাজ। পদ্মাপাড়ের জাহাজঘাট এলাকার বাসিন্দা জাকারুল মাঝি বেলা ১১টার দিকে পদ্মা নদীর ধারে নিজের শেষ সম্বল একটি নৌকা এবং তলিয়ে যাওয়া জমি ও নিজের কষ্টের কথাগুলো এভাবে বলছিলেন জাকারুল মাঝি।


No description available.


তিনি বলেন, আমার খুব মুনে (মনে) পড়ে। চর খিদিরপুরের কথা। নদীতে বান (বন্য বা পানি) আসলে ঘর-বাড়ি ভ্যাঙ্গি (ভেঙ্গে) যাবে বুলি (বলে) আতঙ্গে থাকতু (থাকতাম)। তিন বার বাড়ি ভ্যাঙ্গি (ভেঙ্গে) পিছনে সরি (সরে) গেছি (গিয়েছি)। অনেক বার এরাকম (্এই রকম) হছে (হয়েছে)। কিন্তু ময়াতে (মায়া) আসতে পারতুক (পারতাম) না। এতো কিছু ফেলি (ফেলে) ওই পাড়ে (রাজশাহী শহর এলাকায়) য্যা (গিয়ে) কি খাব। আর কি করবো। তাই থাকি (থেকে) গেছিনু (গিয়েছিলাম) চরে। গত তিন বছর আগের ব্যান্নায় (বন্যায়) পুরাতন (পুরানো) চর ভ্যাঙ্গি (ভেঙ্গে) গেল। দিসি (উপাই) না প্যাই (পেয়ে) এই পাড়ে চলি (চলে) আসনু (আসলাম)।

মাঝি জাকারুল বলেন, এখন নৌকা ব্যাহি (বেয়ে) চরের জিনিসপাতি (জিনিসপত্র) এপাড়ে আনি। তাছাড়া মানুষের জমি করি (চাষাবাদ) পদ্মার চরে। ছেলি-ম্যায়ের (ছেলে-মেয়ে) বিহি (বিয়ে) দিসি (দিয়েছি)। বো (বৌ) মরি (মারা) গেছে। এখন নৌকাই সব।
তিনি আরও বলেন, এই নৌকাডা (নৌকাটা) গড়াছিনু (তৈরি করেছিলাম) তিন বছর আগে। তখন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ল্যাগি ছিলো (লেগেছিল)। বছর বছর ঠিক (মেরামত) করি। রবিবার তিনট্যা (তিনটা) মিস্ত্রি আসিছলো (এসেছিল)। তারা তিন দিন কাজ করিছে (করেছে)। ৩০ হাজার ট্যাকা (টাকা) খরচ করনু (করলাম) নৌকা ঠিক (মেরামত) করতে। এখন আলকাতরা মারিছি (লাগিয়ে) কদিন রোদে শুকাবো। তার পর নদীতে নামাবো।


No description available.


ফেলা আসা দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে জাকারুল মাঝি বলেন, ১৯৯০ সালের আগে থেকি (থেকে) নৌকায় কাজ করি। তখন বালু আনতু (আনতাম) বড় চর থ্যাকি (থেকে)। এখন পর্যন্ত নৌকাতেই কাজ করছি। জীবন যৌবন নৌকাতাকে শেষ হলো। এখন বয়স হ্যাছে (হয়েছে)। অন্য কাম (কাজ) তো করি (করে) খ্যাতে (খেতে) প্যারবো (পারবো) না।

ওই সুমাতে (সময়ে) ৩০০ টাকা করি (করে) পাতু (পেতাম) চর থ্যাকি (থেকে) বালু টানার (আনার) কাজে। তখন বালু তুলা (উত্তোলন) ডেজার ছিলো না। প্যাট (শ্রমিক) দি (দিয়ে) বালু কাটি (কেটে) নৌকা লোড (ভর্তি) করতু (করতাম)। এখন তো সেই খাটনি (পরিশ্রম) নাই। সব মেশিনে হয়।

জাকারুল মাঝি অনেকটাই হতাশার সাথে বললেন- অনেক কষ্ট লাগে। বুক ফ্যাটি (ফেটে) যায় ওই পাড়ে (চর খিদিরপুর) গেলে। বাপ-মা (বাবা-মা) আত্মীয়দের কথা মুনে (মনে) পড়ে। এই চরে জন্মিছিনু (জন্মে ছিলাম)। সেই জায়গা গিলি (গুলো) আর নাই। সব নদীতে ভাঙ্গি (ভেঙ্গে) গ্যাছে (গেছে)। কি আর বুলবো (বলবো) এক পাড় ভাঙ্গে, আরেক পাড় গড়ে।