ঘুস দিলে সার্ভার সচল, না দিলে অচল (ভিডিও)

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউপিতে চলছে ব্যাপক হয়রানি। এ ইউপিতে চেয়ারম্যান সচিব উদ্যোক্তা মিলে সেবাপ্রত্যাশীদের জিম্মি করে আদায় করছেন চাহিদামতো অর্থ।

দীর্ঘ বছর যাবত এই ইউপির জনসাধারণ জিম্মি কার্যালয়ের চেয়ারম্যান, সচিব এবং উদ্যোক্তার কাছে। এতে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এদিকে এ কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধনসহ সেবা সংক্রান্ত সব বিষয়ে ঘুস দিলে সার্ভার সচল থাকে। আর চাহিদা মতো ঘুস না দিলে সার্ভার অচলের অজুহাতে করা হয় হয়রানি। এই ইউপির সচিবের ঘুস গ্রহণের ভিডিও ধারণ করেছেন যুগান্তর প্রতিনিধি।

এদিকে ধামঘর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেমের বিরুদ্ধেও রয়েছে সালিশ দরবারের নামে জনহয়রানি, সেবামূলক কাজ থেকে চাহিদামতো উৎকোচ আদায়সহ নানা অভিযোগ।

চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয় যেন এক মিনি আদালত। যেকোনো সালিশ দরবার শুরুর আগেই পরিশোধ করতে হয় অফিস খরচের নামে উৎকোচ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ধামঘর ইউপি কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন করতে ফির ওপর অতিরিক্ত উৎকোচ না দিলে হয় না জন্মনিবন্ধন ও নাম সংশোধন। জন্মনিবন্ধন করতে গেলে উদ্যোক্তার সুপরিচিত এক কথা সার্ভার বন্ধ আছে এখন হবে না। তবে টাকা দিলে সেই কাজ চুক্তি অনুযায়ী অল্প কয়েক দিনেই করে দেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। তাছাড়া জন্ম-মৃত্যু এবং ওয়ারিশ সনদ, সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, প্রত্যয়নপত্র আনতে লাগে অতিরিক্ত টাকা।

স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুসারে জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনা ফি’তে, জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন থেকে ৫ বছর পর্যন্ত ২৫ টাকা, জন্ম বা মৃত্যুর ৫ বছরের পরে ৫০ টাকা, জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য ১০০ টাকা, জন্ম তারিখ ব্যতীত নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি ফি ৫০ টাকা, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদের নকল সরবরাহ ৫০ টাকা করে ফি বাবদ নিতে পারবে। কিন্তু ধামঘর ইউপিতে কোনোটিই মানা হচ্ছে না।

এখানে প্রতিটি সেবা সংক্রান্ত কাজের জন্য নির্ধারিত ফি থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয়। চেয়ারম্যান, সচিব, উদ্যোক্তা সবাই এক সূত্রে গাঁথা। যার ফলে এ ইউনিয়নের সর্বসাধারণের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এছাড়া দিনের পর দিন অতিরিক্ত টাকা দিয়েও অনেকে পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। জন্ম ও মৃত্যু সনদের ফি নিয়ে ভুক্তভোগীদের কোনো ধারণা না থাকায় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত উৎকোচ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ইউনিয়নে নাম সংশোধনের জন্য উদ্যোক্তা পিয়ারা বেগম নেন ৩০০ টাকা আর সচিব লুনা নাহার নূর নেন ২০০ টাকা। আবার কারো কারো কাছ থেকে একটি জন্মনিবন্ধন করতেই নিয়েছেন উদ্যোক্তা ২ হাজার টাকা সচিব ৫০০ টাকা। ওই ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে এভাবে দীর্ঘদিন যাবত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উৎকোচ আদায় চলছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

সরেজমিন দেখা যায়, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কেউ নিবন্ধনের জন্য টাকা দিচ্ছেন আবার কেউ নিবন্ধন সংগ্রহ করছেন। আবার কেউ চাপা ক্ষোভ নিয়ে খালি হাতে বের হয়ে আসছেন। যারা খালি হাতে বের হয়ে আসছেন তারা টাকা দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।

ধামঘর গ্রামের রাসেল মিয়া বলেন, একটি জন্মনিবন্ধন অনলাইন করতে ২ মাস সময় লেগেছে আর এসব কাজ করতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৮শ’ টাকা।

ওই ইউপির ভূবনঘর গ্রামের আফিয়া বেগম বলেন, আমার নাতির জন্য একটি নিবন্ধন করতে ৬ মাস যাবত এ ইউনিয়ন পরিষদে আসছি। এ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে ধাপে ধাপে ২ হাজার টাকা নিয়েছে তবুও আমি নিবন্ধন পাইনি। আজকে আবার ২নং ওয়ার্ডের গ্রামপুলিশ হোসেন মিয়া ৩০০ টাকা নিয়েছে নিবন্ধন পাওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করবে বলে। ৬ মাস আসা যাওয়ার যাতায়াত খরচ আর হয়রানির কথা বাদই দিলাম।

নোয়াখলা গ্রামের গিয়াসউদ্দিন বলেন, জন্মনিবন্ধন করতে এসেছি; উদ্যোক্তা বলছেন সার্ভার বন্ধ কিন্তু অন্য মানুষের জন্মনিবন্ধন করতে কাগজপত্র জমা নিচ্ছেন।

লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবু কালাম বলেন, আমার বাবার মৃত্যু সনদের জন্য এসেছিলাম, উদ্যোক্তা আমার কাছ থেকে ৩০০ টাকা নিয়েছে আর বলেছে ১ সপ্তাহ পরে আসতে।

খুরুল গ্রামের মো. সেলিম বলেন, নতুন জন্মনিবন্ধনের জন্য এসেছিলাম; উদ্যোক্তা নিয়েছেন ৩০০ টাকা আর সচিব নিয়েছেন ২০০ টাকা। আর বলেছেন ১৫ দিন পরে এসে খোঁজখবর নিতে। ভুক্তভোগীরা এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে প্রতিকার চান।

উদ্যোক্তা পিয়ারা বেগম বলেন, সরকারি ফিসের বাইরে যে টাকা নেওয়া হয় তা দিয়ে অফিসের যাবতীয় খরচ চালানো হয়।

এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আপনি অফিসে আসেন এ ব্যাপারে আপনার সাথে বিস্তারিত কথা বলব।

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিষেক দাশ বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের যাবতীয় কাজে সরকারি ফিসের বাইরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি এ বিষয়ে কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

ইউপি সচিব লুনা নাহার নূর বলেন, জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেই না। উদ্যোক্তাদের কোনো বেতন নাই তাই তারা সরকারি ফিসের বাহিরে কিছু টাকা নেয়। যদি কারও কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে থাকে আপনারা চেয়ারম্যানকে জানান।

ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। একশ্রেণির মানুষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। আর উদ্যোক্তাদের কোনো বেতন নেই, তাই তারা অতিরিক্ত টাকা নেয়। অতিরিক্ত টাকা না নিলে উদ্যোক্তার অফিসের খরচ কীভাবে মেটাবে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর