গোদাগাড়ীর মহাসড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ!

শামসুজ্জোহা বাবু, গোদাগাড়ী:


রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের গোদাগাড়ী এলাকায় লাশের মিছিল থামছে না। গোদাগাড়ী যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কটি গোদাগাড়ী উপজেলার উপর দিয়ে দুই জেলার যোগাযোগ পথ। মাত্র ৫ কিলোমিটার সড়কে ছয় মাসে ঝরেছে ২৫ প্রাণ। বৃষ্টি ছাড়াও মহাসড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝোপ ঝাড়ও এসব সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কি?। গোদাগাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনা একটি অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে! আর হালকা বৃষ্টি হলেই রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে যেন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে যাচ্ছে।


দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- সড়কে আটো, ভটভটি চলাচল ছাড়াও খড়, ফসল শুকানো। এছাড়া সড়কের ফিটনেসের ত্রুটি। দ্রুত গতিতে যানবাহন চলাচলকে দায়ি করছেন তারা।


মানে এই যেমন,আলু,ভাত,পান্তা কিংবা আমাদের নিত্য নতুন মৌলিক চাহিদার মত যেসব জিনিসপত্র আমাদের প্রয়োজন পড়ে সেরকমই বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও! প্রতিদিন টিভি,পত্রপত্রিকা,স্যোসাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চোখে পড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার মত অনাকাঙ্খিত বিষয়!! পত্রপত্রিকার বাইরেও আমাদের পরিবার পরিজন,পাড়া প্রতিবেশি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও প্রায় শুনতে হয় সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত্যুর খবর নয়ত আহত হওয়ার সংবাদ।
 
কিছু পত্রিকায় সড়ক দূর্ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং রাজশাহী জেলা পুলিশ দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে গাড়ীর গতি কমানোর জন্য সাইনবোর্ড লাগালেও এর কোন উপকারিতা পাচ্ছে না সাধারণ জনগন। রাস্তা সংস্করণের পর থেকেই এ সড়কে দুর্ঘটনা বেশী ঘটছে। এতে জনসাধরণের মনে প্রশ্ন জাগছে রাস্তা নির্মাণে কোন ঘাটতি নাই তো? কারণ বৃষ্টি হলেই গাড়ী রাস্তায় না থেকে সরাসরি খাদে পড়ে যাচ্ছে।
এ বছর উপজেলায় মোট সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৪০ টিরও বেশী। আমাদের অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা,ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ চালক,যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত চলাচল, ওভারটেকিং, সিগন্যাল তোয়াক্কা না করাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে! যার ফলশ্রুতিতে আমরা হারাচ্ছি পরিবারের কোনো সদস্য,আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশিকে!
 
আবার হালকা বৃষ্টিতেসহ বিভিন্ন উৎসব যেমন ঈদ, পূজা বা কোনো দিবসেও সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা অনেকগুন বেড়েছে! এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদেরকেই বের করতে হবে। সড়ক বিভাগের আইনের প্রয়োগ বৃদ্ধি,ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ,দক্ষ চালক,নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাসহ ওভারলোডেড যাত্রী উঠানামা বন্ধ করে দেশে একটা সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধির জোর চেষ্টা চালাতে হবে।
 
জানিনা আর কত জীবন গেলে নিজের জীবনের নিরাপত্তা আমরা পেতে পারি? সুমুন নামে একজন চালক বলেন, রাস্তায় হালকা বৃষ্টি হলেই ছোট গাড়ীর ব্রেক কম কাজ করছে। এবং রাস্তায় বেশী তাপমাত্রায় পিচ গলে চটচটে হয়ে যাচ্ছে। ফলে সঠিক ভাবে গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বৃষ্টি বা অতিরিক্ত রোদ হলে ব্রেক না কাজ করার কারণ হলো গাড়ী ভেসে যাচ্ছে ফলে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছড়া আঁকাবাঁকা রাস্তা গুলোর দুই ধারে ঝোপঝাড়ে কারণে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি গুলো আমরা দেখতে পাই না এর কারনেও দূর্ঘটনা বেশি হয়।

সম্প্রতি ১৩ জুন  গোদাগাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় হালকা বৃষ্টির সময় দুই বিজিবি সদস্য নিহত হয়েছে। এঘটনায় আরো ৪ জন আহত হয়েছে। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের সারাংপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বিজিবি সদস্যেরা হলেন ল্যান্স নায়েক জুবায়ের (৩৪) ও ল্যান্স নায়েক আবু সাঈদ (৩৫) তারা বিজিবির রাজশাহী ৫৩ ব্যাটালিয়নের সদস্য।


 
গোদাগাড়ী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সূত্র মতে, হালকা বৃষ্টি ও অতিরিক্ত রোদ হলেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এ বছর সড়কে জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৯ জন। আর শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই ৪ শিশুসহ ১২জনের মৃত্যু হয় । এসব দুর্ঘটনায় আরো ৩০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া গোদাগাড়ী এলাকায় ৬ মাসে ৩০ টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিকেরও বেশি মানুষ।
 
এদিকে চলতি বছরের গত ২৬ জানুয়ারি বিজয়নগর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গোদাগাড়ীতে নসিমন উল্টে খাদে পড়ে শরীফুল ইসালাম (৪৮) নামে মাছ ব্যবসায়ী নিহত হন। নিহত শরীফুল উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের মান্ডইল গ্রামের ইয়াসিন আলীর ছেলে। গত ২৪ জানুয়ারি গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় আকরাম হোসেন (৪৮) নামে এক কলেজ শিক্ষক নিহত হন।
 
গত ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে গোদাগাড়ী উপজেলার সাধুর মোড় এলাকায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় আব্দুল আলিম সোহাগ (১২) ও সুমন (১১) নামে দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। তারা উপজেলার নবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলো। এছাড়াও গত জানুয়ারী মাসে লালবাগ ও সিএন্ডবি এলাকায় ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাবা মায়ের সামনেই দুই শিশু নিহত হয়।
 
১২ ফেব্রুয়ারি সকাল পোনে ৮ টার দিকে গোদাগাড়ীতে মিনি পিকাপ ও ট্রাকে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজনের মৃত্যু হয়। রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের রাজাবাড়ী হাট এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
 
ঈদের দিন আনন্দ ভ্রমণে বের হয়ে গোদাগাড়ীর সড়কে প্রাণ হারালেন তিন মোটরসাইকেল চালক। এর আগে ঈদের আগের দিন রাতেও সড়কে প্রাণ হারায় আরেকজন। নিহতরা চারজনই ছিল ছাত্র।
 
নিহতারা হলেন- গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ গাঙ্গোবাড়ী গ্রামের গোলাম রব্বানীর ছেলে নাসিম, বিদিরপুর গ্রামের খাইরুল ইসলামের ছেলে রিয়াদ (১৮), মোহনপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে রাশেদ (২০), শ্রীমন্তপুর গ্রামের শামসুলের ছেলে রিপন (১৬)। চারজনই মোটরসাইকেলের চালক ছিলেন।
 
এ বছরের সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনাটি ঘটে ১ মার্চ।এ দিন একটি প্রাইভেট বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় রাজশাহী থেকে চাপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে গোদাগাড়ী থানাধীন কাদিপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পাশে উল্টে যায়। এতে মাইক্রোচালকসহ একই পরিবারের ৬জনসহ নিহত হন। নিহতরা কার চালক ছাড়া সকলেই নগরীর বোয়ালিয়া থানার মোন্নাফের মোড়ের বাসিন্দা। নিহতরা হলেন, ওই এলাকার মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে আকাশ হোসেন (৪০), আকাশের স্ত্রী হাসনারা বেগম (৩৫), তাদের শিশু সন্তান মুশফিরা খাতুন (৮), আদিব আল-হাসান (৪মাস), আসিয়া খাতুন (৩০) ও আতিয়া পূর্নিমা (২৩), মাইক্রোচালক মাহাবুবুর রহমান (৩৮)
গোদাগাড়ী ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন মাষ্টার আতাউর রহমান বলছেন, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা তার আগের বছরের তুলনায় অনেক গুনে বেড়েছে আর এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছে হাজারও মানুষ, এমনকি মৃত্যুর হারও বেড়েই চলেছে। এবছর যে পরিমান মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তা পূর্বের বছরের তুলনায় অনেক বেশী।
 
রাজশাহী জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকারী সভাপতি ওলিউল্লাহ জিয়া বলেছেন অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে আটো, ভুটভুটি মহাসড়কে চলাচল, রাস্তায় খড়, ফসল শুকানো, অপরিকল্পিতভাবে ট্রাকে মাটি বা বালু উত্তলনের সময় সড়কে পড়ে যাওয়ায় রাস্তা ব্যবহার উপযোগী হয়ে না থাকায় সড়ক দূর্ঘটনা বেশী ঘটছে । এছাড়াও অপ্রাপ্তবয়স্ক বাস, ট্রাক, আটো বা মটর সাইকেল চালকের জন্যও দূর্ঘটনা বেশী হচ্ছে । রাস্তা নির্মানে কোন গাফেলতি আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে।
 
গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। এছাড়া গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও গাড়ি ড্রাইভারদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়েছে। গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রন করে রাখা ও ওভারটেকিং বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন,রাজশাহী-গোদাগাড়ী সড়কে পুলিশের কয়েকটি চেকপোস্ট রয়েছে। সেখানে গাড়ির কাগজপত্র দেখা হয়। এই চেকপোস্টগুলোতে যানবাহনের সিট ক্যাপাসিটি (বসার ধারণ ক্ষমতা) দেখা হবে। প্রয়োজনে মামলাও দেয়া হবে। সব মিলে ট্রাফিক আইন মেনে চললে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। এ সড়কে দুর্ঘটনা রোধে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,  স্পিড ব্রেকার বসানো বা গাড়ির স্পিড টেস্টের বিষয়ে আমাদের পাশাপাশি ট্রাফিক বিভাগ দেখাশোনা করে।
গোদাগাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহামদ বলেন,গত কয়েকদিনে গোদাগাড়ী মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেশী হওয়ার কারণ হল সুন্দর রাস্তা! রাস্তা ভাল হওয়ায় সকলে গাড়ী দ্রুতগতিতে চালাছে। বেশী তাপমাত্রায় পিচ গলে যাওয়া প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,রাস্তা তৈরীর সময় বিটুমিন বেশী হওয়ায় এমন হচ্ছে। ফলে গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ সঠিক ভাবে না হতে পারে।তবে বিটুমিন কম হলে রাস্তার স্থায়ীত্ব কম হবে। রাস্তা পিচ্ছিল দূর করতে হলে মহাসড়কে ডাবল বিটুমিনার সার্ফেসিটি টির্টমেন্ট (ডিবিএসটি) অর্থাৎ রাস্তার উপরে হালকা উচু উচু পাথর বসালে পিচ্ছল কমবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
 
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে এসব দূর্ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে দূর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে তা দ্রুত নির্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসক একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। গত (১৮ জুন) বৃহস্পতিবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের নির্দেশে  জেলা অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শামসুজ্জোহা, গোদাগাড়ী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ খাইরুল ইসলাম  ও বিআরটিএ এর একজন প্রতিনিধিসহ কয়েকজন নিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে পরিদর্শন করা হয়েছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের সাথে আলোচনা করে দুর্ঘটনা রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় যা করা দরকার তা করতে হবে।
 
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা বলেন, এবিষয়গুলো নিয়ে আমরা উপর মহলে কথা বলেছি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।পূর্বের দূর্ঘটনার পরিপেক্ষিতে সতর্কীকরণ বোর্ড স্থাপন করেছি। তাতেও কোন লাভ হচ্ছেনা। কারণ ঘুমন্ত চালক,অপ্রাপ্তবয়স্ক হেলপার দিয়ে গাড়ী চালালো,অসাবধানতা,দীর্ঘ সময় ধরে ড্রাইভিং করা,ফিটনেশ বিহীন গাড়ী সড়কে চলাচলের করণে রোধ হচ্ছেনা সড়ক দূর্ঘটনা। এই সব দূর্ঘটনা থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
 
ডাবল বিটুমিনার সার্ফেসিটি টির্টমেন্ট (ডিবিএসটি) বেশি ব্যবহার করার বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কি কখনো  বিটুমিন বেশী ব্যবহার করে বাড়তি খরচ করবে বা করলেও  অনুমোদন দিবে না মন্ত্রনালয় । তবে রাস্তা নির্মানে আমাদের কোন ঘাটতি নাই।