গোডাউনে পড়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো সহায়তার চাল

বরাদ্দ আসার ১৫ দিন পরেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তার ১০ টাকা কেজি দরের চাল পায়নি মুলাদী পৌরসভার ৩৫ হাজার মানুষ। কী কারণে এই দেরি তারও কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারছে না কেউ।

পৌর মেয়র বলছেন, ‘আরো অন্তত ১০ দিন আগে দরিদ্র মানুষের তালিকা জমা দেয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরে। তারা কেন কার্যক্রম শুরু করছে না সেটা তারাই বলতে পারবে।’

আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলছেন, ‘কাজ চলছে। নিয়মানুযায়ী চলতি মাসের মধ্যে এই চাল দিতে হবে আমাদের। আশা করছি ২/৩ দিনের মধ্যেই শুরু করতে পারবো বিতরণের কাজ।’

চাল বিতরণে বিলম্ব প্রশ্নে ভেতর থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, দুই জনপ্রতিনিধির তালিকা সমন্বয়য়ের চেষ্টা করতে গিয়েই সাহায্য বঞ্চিত হচ্ছে অসহায় মানুষ।

প্রথা অনুযায়ী পৌর এলাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের চাল বিতরণের নিয়ন্ত্রন পৌর পরিষদের হাতে থাকার কথা থাকলেও ইউএনও চাইছেন পৌর পরিষদের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদকেও মূল্যায়ন করতে। ফলে মেয়র আর উপজেলা চেয়ারম্যানের তালিকা সমন্বয় করার চেষ্টার কারণেই নাকি চরম দুর্যোগের এই মুহূর্তেও গোডাউনেই পরে আছে গরিব মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো সহায়তার চাল।

ক্ষমতায় আসার আগে দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ৪ বছর আগে দেশে শুরু হয় ১০ টাকা কেজি দরে দরিদ্র মানুষের মধ্যে সরকারিভাবে চাল বিক্রি।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, শুরু হওয়া এই কার্যক্রমকে তাই শেখ হাসিনার সহায়তা বলেই জানে মানুষ। শুরু থেকে এই চাল দেয়া হত কেবলমাত্র ইউনিয়ন পর্যায়ে। উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে বিক্রি হত চাল। সঠিকভাবে বন্টন প্রশ্নে দরিদ্র মানুষের একটি তালিকাও করা হত আগেভাগে।

তালিকা করার দায়িত্বে থাকা কমিটির প্রধান সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। সদস্য সচিব হিসেবে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক থাকার পাশাপাশি স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌর মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিসহ কমিটির মোট সদস্য ৭।

শুরু থেকেই কেবল ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে এই চাল বিক্রি হওয়ায় খুব একটা ভূমিকা ছিল না পৌর পরিষদের। পৌর এলাকার জন্য কখনো কোন বরাদ্দও আসেনি।

চলমান করোনা দুর্যোগে বিষয়টি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দরিদ্র মানুষের সহায়তায় পৌর শহরগুলোতেও ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রির নির্দেশনা দেন তিনি। সেই অনুযায়ী বরিশালের মুলাদী পৌরসভাতেও আসে চাল বরাদ্দের চিঠি।

গত ২৫ এপ্রিল ৪৮ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দের চিঠি পাওয়ার কথা জানান উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। দেশের অন্যসব পৌর এলাকায় যেখানে বর্তমানে সরকারিভাবে আসা এই বিশেষ বরাদ্দের বিতরণ চলছে পুরোদমে সেখানে মুলাদী পৌরসভায় চোখে পড়েনি কোন উদ্যোগ। দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা সরকারি ছুটি এবং দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে দেশজুড়ে যখন অভাবের হাহাকার ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিশেষ বরাদ্দ আসার ১৫ দিন পরও কেন তা বিতরণ হয়নি খোঁজ নিতে গিয়ে মেলে খুশি অখুশি আর তালিকা নিয়ে টানা-হেচড়ার খবর। যে কারণে হাতের নাগালে থাকা চাল জুটছে না অসহায় মানুষের ভাগ্যে।

মুলাদী পৌরসভার মেয়র শফিকুজ্জামান রুবেল বলেন, ‘যতদূর জানি মোট ৪৮ মেট্রিকটন চাল এসেছে ২ হাজার ৪০০ মানুষের জন্য। কম করে হলেও ১২ হাজার মানুষ উপকৃত হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উপহারে। ইউএনও মহোদয় আমার কাছে তালিকা চাওয়ার পর গত ৩০ এপ্রিল আমি ২ হাজার ১০১ জনের একটি তালিকা তার কাছে পাঠিয়েছি। এদের মধ্যে ৫০০ জনের তালিকা দিয়েছেন আমাদের সংসদ সদস্য মহোদয়। মোট ২ হাজার ৪০০ জনের নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও ৩শ’ জনের নাম আমি দেইনি। যেহেতু কমিটিতে আরো একজন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন এবং সভাপতি হিসেবে ইউএনও সাহেবেরও কিছু অবলিগেশন থাকতে পারে তাই ৩শ’ নাম ফাঁকা রেখেছি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিগত ৪ বছর ধরে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরের চাল। এবারের এই বরাদ্দ শুধুমাত্র পৌর এলাকার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই চাল বিতরণের তালিকা করার কথা পৌর পরিষদের। এখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ থাকার সুযোগ নেই। তারপরও আমি এমপি মহোদয়ের পাঠানো ৫শ’ জনের তালিকা এরমধ্যে অর্ন্তভ‚ক্ত করেছি। ৩শ’ নাম ফাঁকাও রেখেছি। তারপরও কেন চাল বিতরণ হচ্ছে না সেটা উপজেলা প্রশাসন বলতে পারবে।’

বিষয়টি সর্ম্পকে জানতে চাইলে মুলাদীর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শুভ্রা দত্ত বলেন, ‘প্রাপ্ত তালিকার যাচাই বাছাই চলছে বর্তমানে। এই কাজ শেষ হলে বিতরণ শুরু করবো আমরা।’

অন্যান্য পৌর এলাকায় যেখানে বিতরণ শুরু হয়ে গেছে এবং পৌরসভার তালিকা এসেছে আরো অন্তত ১০ দিন আগে সেখানে যাচাই-বাছাইয়ে এতো দেড়ি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তালিকা নিয়ে জটিলতার কারণে বিলম্ব হচ্ছে।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ‘পৌর এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ আসা এই চালের তালিকা প্রশ্নে উপজেলা চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপের কারণে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতার। চেয়ারম্যান চাইছেন তার দেয়া তালিকার সিংহভাগ থাকুক চূড়ান্ত তালিকায়। এদিকে এমপি ও মেয়র মিলে পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১০১ জনের নাম। ফলে জটিলতায় পড়েছেন ইউএনও। কাকে খুশি রাখবেন আর কে অখুশি হবে সেই টানাপোড়েনেই বিলম্ব হচ্ছে বিতরণে। নিয়মানুযায়ী পৌর এলাকার জন্য আসা বরাদ্দ প্রশ্নে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী পৌর পরিষদ। কিন্তু তালিকা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।’

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে উপজেলা চেয়ারম্যান তারিকুল হাসান মিঠুর মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়ার রহমান বলেন, ‘তালিকা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি আমিও অবগত। তবে যেহেতু ইউএনও কমিটির প্রধান তাই তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আশা করছি যে ২/৩ দিনের মধ্যে সব জটিলতা সামলে সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের সহায়তা বিতরণ শুরু হবে।’