বুধবার , ২৮ আগস্ট ২০২৪ | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

গাজী টায়ার্সে আগুন: স্বজনের আর্তনাদ, অপেক্ষা দেহাবশেষ পাওয়ার

Paris
আগস্ট ২৮, ২০২৪ ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

মাথায় হাত রেখে রূপগঞ্জের গাজী টায়ার্স ফ্যাক্টরির সামনে জলাধারের পাশে বসে ছিলেন ইমরান হোসেন। ভাতিজা মো. বাবুর (১৮) খোঁজে দু’দিন ধরে সেখানে অপেক্ষা করছেন তিনি। তবে তাঁর সন্ধান মিলছে না! গত রোববার অনেকের সঙ্গে কারখানায় ঢোকেন গাইবান্ধার সাঘাটা থানার মো. বাবু। এখন তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ। ভাতিজাকে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ইমরান বলেন, ‘কেমনে আর লাশ পামু! পুইড়া তো সব ছাই হইয়া গ্যাছে।’ গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

বাবু রিকশা চালাতেন। প্রেম করে বিয়ে করার পর স্ত্রী নিয়ে থাকতেন রূপগঞ্জে। বাবুর স্ত্রীও সেখানকার একটি কারখানায় চাকরি করেন।

গত রোববার রাতে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার্স ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ৬০ ঘণ্টা পার হলেও কারখানার ভেতরে উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। ছয়তলার ভবন থেকে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ঢোকা যাচ্ছে না। সেখানে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ভবনের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে এবং ভবনটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। রোববার ভোরে রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী।

কারখানার সামনে বিলাপ করেন নিখোঁজদের বহু স্বজন। নারী-পুরুষ ও শিশুদের আহাজারিতে সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্থানীয়রা ১৭৬ জন নিখোঁজ থাকার দাবি করছেন। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, সংখ্যাটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভয়াবহ দাহ্যের মধ্যে এত সময় ধরে আগুনে পুড়লে ছাই ছাড়া কিছু পাওয়া দুষ্কর। আর যত লোক নিখোঁজ থাকার কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। টায়ার পুড়লে তা থেকে দাহ্য পদার্থ তৈরি হয়। যতই পানি দেওয়া হোক, তখন আগুন নেভাতে সময় লাগে।’

তিনি বলেন, ‘ভবনের যতটুকু জায়গা আমাদের কর্মীরা দেখেছেন, সেখানে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় যাওয়া সম্ভব হয়নি।’ ভবনটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। গণপূর্তের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চাওয়া হয়েছে। হতাহতের বিষয় নিশ্চিত হতে ঘটনাস্থলের আলামত ল্যাবে পাঠানোর কথাও জানান তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক বলেন, ‘ফ্যাক্টরিতে অনেকে লুটপাট করতে যায়। লুটপাটের পর তারা সেখানে আগুন দিয়েছে। লুটপাটের সঙ্গে জড়িত অনেকে পালিয়ে যেতে পারে।’

গাজী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন, ফায়ার সেফটি, নিরাপত্তা, এইচআর ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে কারা জড়িত, তা জানা নেই। প্রথম দফায় ৫ আগস্ট আগুন দেওয়া হয়। সিসি ক্যামেরার সরঞ্জাম যেখানে ছিল, সেখানেই হামলা হয়। এ ব্যাপারে থানায় জিডি রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় গত রোববার পুড়িয়ে দেওয়া হয় কারখানাটি। হামলার আগে মসজিদে মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়। আমাদের কোনো শ্রমিক নিখোঁজ নেই। যারা নিখোঁজ তারা লুটপাট করতে এসেছিল।’

কারখানাটি ঘুরে দেখা যায়, ছয়তলা ভবন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। ৯৬ বিঘা জমির ওপর কারখানা কমপ্লেক্সের পুরোটা এখন ধ্বংসস্তূপ। কারখানার সামনের একটি জলাধারে তেল জাতীয় পদার্থ ভাসছে। কারখানা থেকে এসব জলাধারে এসে পড়েছে।

গাজী টায়ার্স ফ্যাক্টরির পেছনের এলাকাটির নাম খাদুন। সেখানে কিছু লোককে চোরাই তার, স্টিল, প্লাস্টিক, তামাসহ নানা সরঞ্জাম বিক্রি করতে দেখা যায়। কারখানা থেকে তারা এসব লুট করে এনেছে। স্থানীয় বাসিন্দা রওশন আরা বলেন, ‘কয়েকজনের কাছ থেকে তামার তার ৮০০ টাকা কেজিতে কিনেছি। এগুলো খুচরা বিক্রি করব।’

খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম লুৎফুর রহমান জানান, দুই দফা মসজিদ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। প্রথমে বেলা ১১টায়। তখন বলা হয়, ‘গাজী সাহেব গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিশা টেক্সটাইল মিলের সামনে মানববন্ধন হবে। যাদের জমিজমা গাজী সাহেব দখল করে রেখেছিলেন, তারা মানববন্ধনে হাজির হন।’ এর পর রাত ৩টার দিকে আবার মাইকিং করে বলা হয়, ‘এলাকায় ডাকাত আসতে পারে। সবাই সাবধান থাকেন।’ ওই মসজিদের মোতাওয়াল্লি আমানুল্লাহ খান বলেন, ‘রূপসীতে প্রতি কাঠা জমি ১০-১৫ লাখ টাকায় বেচাকেনা হয়। গাজী সাহেব ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক কম দরে জমি কিনে কারখানার আয়তন বাড়ান। অনেক লোককে রাতারাতি ভিটেমাটিছাড়া করেন।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি জানান, লুটপাট নিয়ে রোববার রূপসীর লোকজনের সঙ্গে বাইরের একটি গ্রুপের মারামারি ও কোপাকুপি হয়। কারা জিনিসপত্র আগে লুট করবে– এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এ ছাড়া স্থানীয় দুটি গ্রুপ ফ্যাক্টরিতে ঢোকে। তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। অনেকে বলেন, ভবনের ছয়তলায় লুটপাট চলাকালে নিচতলায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ভেতরে থাকা অনেকে আটকা পড়ে।

আট সদস্যের তদন্ত কমিটি

গাজী টায়ার্সে আগুনের ঘটনায় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তদন্ত কমিটিতে বিদ্যুৎ, কলকারখানা, ফায়ার সার্ভিসসহ সব বিভাগের সদস্য রয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ভবনের ভেতরে সালফারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ধোঁয়া রয়ে গছে। এ কারণে উদ্ধারকাজ চালানো যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে নিখোঁজের একটি তালিকা করবে প্রশাসন। তবে এখন পর্যন্ত ওই তালিকা না পাওয়ায় রূপগঞ্জের শিক্ষার্থীরা তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা ১২৬ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেন। পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও গতকাল কারখানা পরিদর্শন করে।

এর আগে সকাল থেকেই নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানা এলাকায় ভিড় করেন। উদ্ধারকাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। কারখানার সামনে একমাত্র ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিন বোন। থেমে থেমে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের মধ্যে একজন পারভীন আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই বাবুল মিয়াকে খুঁজছি। ভায়রা সুমনের সঙ্গে বাবুলও নিখোঁজ।’

একটি ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন

গাজী টায়ার্সে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা আগের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে রূপগঞ্জে। এতে দেখা যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দীপুর অনুসারী স্থানীয় বিএনপি নেতা হাফিজুর রহমান পিন্টু লুটপাট করতে আসা কিছু লোককে সেখান থেকে বের করে দিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে– ওই সময় পিন্টু কেন সেখানে।

রূপগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার সামনে কথা হয়। এদের একজন বরপা এলাকার মফিজুল। আত্মীয় আরিফের (১৩) খোঁজে তিনি সেখানে। আরিফের বাবা আনোয়ার হোসেন থাকেন বরপার দক্ষিণ মাসাবো এলাকায়। মফিজুল একটি ভিডিও দেন। যেখানে তারাব পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান পিন্টুকে লুটপাট করতে আসা লোকজনকে গাজী টায়ার্স থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। তাঁর বাধায় অনেকের সঙ্গে মোটরসাইকেলে আসা দুই যুবকও ফিরে যায়। এই ভিডিও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের কাছেও গেছে। জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও তারাব পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পিন্টু দলের নির্দেশ ছাড়া কেন সেখানে গিয়েছিল? নিশ্চয় কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে সেখানে গেছে। ভালো উদ্দেশ্যে গেলে সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা। গাজী সাহেবের রিমান্ডের খবরে আনন্দ মিছিল করতে গেলেও বন্ধ ফ্যাক্টরির ভেতরে তারা কেন ঢুকবে?’

এ বিষয়ে হাফিজুর রহমান পিন্টুকে ফোন দিলে তিনি ধরেননি। পিন্টুর বাসার সামনে তাঁর চাচাতো ভাই আমজাদ ভূঁইয়া বলেন, ‘গাজী টায়ার্সের ঘটনায় নয়, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে বিএনপির কিছু লোক চাঁদাবাজি করতে গেলে এর বিচার আসে পিন্টু ভাইয়ের কাছে। তিনি চাঁদাবাজি করতে নিষেধ করলে সন্ত্রাসীরা তাঁর বাসায় হামলা চালায়।’ আমজাদ আরও বলেন, ‘বিএনপির কাজী মনির গ্রুপের সঙ্গে এখন আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ মিলে চাঁদাবাজি করছে। রোববার বিকেলে আমরা রূপসীতে ছিলাম। এ সময় পিন্টু ভাইয়ের কাছে ফোন আসে, বিএনপির লোকজন গাজী টায়ার্সে লুটপাট করছে। আমরা গিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। তাদের ধাওয়া করে গাজী টায়ার্সের শেষ মাথায় নিয়ে যাই। কিন্তু তারা এক পর্যায়ে পাল্টা হামলা চালালে আমরা কোনো রকম জান নিয়ে ফেরত আসি। আমাদের কর্মী মেহেদী গুরুতর আহত হয়ে এখন হাসপাতালে।

 

 

সর্বশেষ - জাতীয়