গণগ্রেফতারের ভয়ে পুরুষশূন্য ১০ গ্রাম

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

কুড়িগ্রামে গণগ্রেফতারের ভয়ে ৩ ইউনিয়নের ১০ গ্রামের পুরুষ মানুষ বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। আতঙ্কে রয়েছেন ওই এলাকার নারী ও শিশুরা। গ্রামগুলোতে ভাটা পড়েছে ব্যবসা ও আয়মূলক কর্মকাণ্ডে। মজুরের অভাবে জমিতে নষ্ট হচ্ছে সবজি। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দালালরা মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অজ্ঞাতসহ ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ। এ কারণে এই ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে উলিপুর থানা পুলিশ জনিয়েছে, গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যাচাই-বাছাই করে আটক করা হচ্ছে। দালাল চক্রের বিষয়টিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের নজরে এসেছে। সেটি কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় একটি মন্দিরে কুরআন শরীফ অবমাননার ঘটনায় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৫টি মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা প্রতিমা ভাঙচুরসহ বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়।

পরে উলিপুর থানা পুলিশ বাদী হয়ে মন্দির ভাংচুর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে পৃথক ৫টি মামলায় ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ প্রায় ৭ শতাধিক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আর এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ৬৬ জনকে।

সরেজমিন দেখা যায়, গ্রেফতার আতংকে ওইসব গ্রামে দিনের বেলা কিছু মানুষ চোখে পড়লেও বিকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে গ্রামগুলো। এর ফলে হাটবাজারগুলোতে আগের মতো থাকে না কোলাহল। নতুন মানুষ দেখলেই এড়িয়ে চলছে সবাই। বেচাকেনা না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকজন।

উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের রামপ্রসাদ পাড়ার বাসিন্দা কৃষক বাবলু মিয়া (৬০) জানান, মামলার ভয়োত কামলারা পলাইছে। এ্যালা শাক তোলার কামলা পাবার নাগছি না। হামার এটে এবার ভালই শাকসবজি হইছে। কিন্তুক বর্তমানে এলাকাত পুরুষ মানুষ নাই। ফকির মিস্কিনও এই গ্রামোত আসপের চায় না।

একই ইউনিয়নের সাতদরগা গ্রামের মুদি দোকানদার জাহাঙ্গীর (৫৫) জানান, হামার এটে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ আর মাদ্রাসা ছাত্ররা বাড়ি ছাড়ি পালাইছে। মুই পঙ্গু মানুষ সাহস করি দোকানদারি করবের নাগছং। গন্ডগোলের পর থাকি বেচাকেনা নাই। চা বেচেয়া কোনদিন দশ টেকা কোনদিন বা ২০ টেকা লাভ হয়। এই দিয়া কি সংসার চলে।

থেতরাই বাজারের পাশে ফকিরপাড়ার বাসিন্দা সাথী আক্তার জানান, গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো পালিয়ে রয়েছে। সন্তানদের খাবার মুখে তুলে দিতে এলাকার নারীরাই এখন বাজার করছে। যে কোন গাড়ির হর্ণ শুনলেই বাাচ্চারা ভয়ে কেঁদে ওঠে। রাতে স্বাভাবিকভাবে কেউ ঘুমাতে পারি না।

বাজারের অটোচালাক খোরশেদ আলম জানান, আগে দিনে আটশ থেকে হাজার পর্যন্ত আয় হতো। কিন্তু মামলার পর থেকে এলাকায় পুরুষ শূণ্য হওয়ায় প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন দিনে দুই-আড়াইশ টাকার বেশি কামাই হচ্ছে না।

গত ১৩ অক্টোবরের ঘটনায় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় ৩টি ইউনিয়নের ৫টি মন্দিরের মধ্যে গুনাইগাছ ইউনিয়নে ৩টি মন্দিরে হামলা করা হয়। এগুলো হচ্ছে পশ্চিম কালুডাঙ্গা ব্রাহ্মণপাড়া দুর্গা মন্দির, পশ্চিম কালুডাঙ্গা সার্বজনীন দুর্গা মন্দির ও নেফড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দির ভাঙচুর করা হয়। এছাড়াও থেতরাই ইউনিয়নে হামলা করা হয় হোকডাঙ্গা ভারতপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দির এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে বেগমগঞ্জ সার্বজনীন দুর্গা মন্দির। এ সময় দুর্বৃত্তরা মন্দিরসহ প্রতিমা ভাংচুর, মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।

মামলার পর থেকে গুনাইগাছ ইউনিয়নের নেফড়া, কালুডাঙ্গা গ্রামের কাঠালীপাড়া, হাজীপাড়া, খারিজাপাড়া, মৌলভীপাড়া, পূর্বপাড়া, কালুডাঙ্গাপাড়া এবং থেতরাই ইউনিয়নের রামপ্রসাদ, হোকডাঙ্গা, কিশোরপুর, বকশিপাড়া, তেলিপাড়া, থেতরাই বাজার এলাকার ফকিরপাড়া, সাতদরগাহ্, বকশিরবাজার, দালালীপাড়া, মতুল্ল্যাটারী, বকশিপাড়া, নাপিতপাড়া, হাজীপাড়া, কানিপাড়া, তেলিপাড়া পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

দিনের বেলা নারী এবং বৃদ্ধরা বাজার ঘাট করলেও রাতের বেলা যেন এলাকা ফাঁকা হয়ে পড়ে। একদিকে পেটের জ্বালা অপরদিকে পুলিশি গ্রেফতার আতঙ্কে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো স্বস্তি নেই। পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে আশপাশের গ্রামসহ হাট বাজারগুলোতে। বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জানান, প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশে সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করতে দেয়া যাবে না। তবে দালাল চক্র যাতে ফায়দা লুটতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেটি প্রভাব ফেলতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে উলিপুর থানার ওসি মো. ইমতিয়াজ কবীর জানান, এখন পর্যন্ত ৫টি পৃথক মামলায় ৬৬ জনকে আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যাবলি এবং ভিডিওর মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিরীহ কেউ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সে ব্যাপারে পুলিশ সজাগ রয়েছে। আর গ্রামের সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র: যুগান্তর