ক্রেতা সঙ্কটে আম পাড়ছেন না রাজশাহীর চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:


ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে রাজশাহীতে গড়ে অন্তত ৪০ ভাগ আম ঝরে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের দিন থেকে শুরু করে গত কয়েকদিন ধরেই আম ঝরে পড়েছে। কারণ গাছে যেসব আম রয়েছে, সেগুলোর কিছু অংশ ঝড়ে আঘাতপ্রাপ্ত। সেই আমগুলো ঝরে পড়ছে এখন। তার পরেও রাজশাহীতে এখনো গাছে গাছে যথেষ্ট আম রয়েছে বলে দাবি করেছেন আমচাষিরা। কিন্তু এরই মধ্যে বাজারে আসতে শুরু করা আম নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন বিপত্তি। করোনা আতঙ্কে বাজারে তেমন ক্রেতা না থাকার কারণে আমচাষিরা বাগান থেকে আম তেমন পাড়ছেন না বলে জানিয়েছেন।

আবার যেসব চাষিরা আম বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন, তারাও চাহিদামতো দাম পাচ্ছেন না। অন্যদিকে দাম না পেয়ে যারা আম এখনো পাড়তে শুরু করেননি তাঁদের মধ্যে রয়েছে ঝড়-ঝাপ্টা নিয়ে শঙ্কা। এই সময়ে ঝড়-ঝাপ্টা হলে পোক্ত হয়ে যাওয়া আমের বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলেও জানিয়েছেন চাষিরা। ফলে করোনা, আম্ফান ও বৈরী আবহাওয়া নিয়ে এবার আমচাষিরা রয়েছেন চরম শঙ্কায়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহীর বানেশ্বর হাট ঘুরে দেখা গেছে, এ বাজারে শ’খানেক ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। তাঁরা আম কেনা-বেচার জন্য জড়ো হয়ে আছেন। আবার আম নিয়ে অপেক্ষা করছেন ভ্যান চালকরা। সবমিলিয়ে হাটে আম বিক্রির লোকই বেশি। কেনার লোক হাতেগোনা ৬-৭ জন। ফলে আম নিয়ে অনেকটা চাতক পাখির মতোই বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও গতকাল এ বাজারে প্রতিমণ গোপাল ভোগ আম বিক্রি হয়েছে ১২শ থেকে শুরু করে ১৫শ’ টাকা দরে। আর গুটি বা আঠি জাতের আম বিক্রি হয়েছে ৮শ’ থেকে ১২শ’ টাকা দরে। তবে এ জাতের আম ৮-৯শ’ টাকা দরেই বেশি বিক্রি হতে দেখা গেছে। তারপরেও তেমন ক্রেতা না থাকায় বেশ আরও কম দামে বিক্রি করে বাড়ি চলে যেতে দেখা যায়।

বাজারে আম বিক্রি করতে আসা পুঠিয়ার মহেন্দ্রা এলাকার জমসেদ আলী বলেন, ‘গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাজারে গোপালভোগ আম আসছে। কিন্তু দাম এখনো বাড়েনি। অথচ গত বছর গোপাল ভোগ আম শুরতেই ছিল ১৫-১৬শ টাকা মণ। কিন্তু এবার সেখানে ১২শ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার গত বছর সপ্তাহ খানেক যেতেই গোপালভোগ বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে ২২শ টাকা দরে। কিন্তু এবার সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৫শ’ টাকা দরে। তার পরেও বাজারে তেমন ক্রেতা নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার পাইকাররা না আসায় আম কেনার তেমন লোক নাই। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী ঢাকা, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে আম কিনছেন। মোবাইলে ওই ব্যবসায়ীরা যে দাম বেধে দিচ্ছেন, এখানকার ব্যবসয়ীরা সেই দামেই আম কিনছেন। তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি আমরা আমচাষিরা।’

আরেক আমচাষি নাবিউল বলেন, ‘বাজারে বাইরের ক্রেতা যখন বেশি থাকবে, তখন প্রতিযোগিতা করে তারা আম কিনবেন। এতে দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। চাষিরা লাভবান হয়। কিন্তু বাজারে এবার বাইরের ক্রেতা না থাকায় আম কিনতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে কোনো প্রতিযোগিতা থাকছে না। তারা বেধে দেওয়া দরেই আম কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এতে আমরা চাষিরা সেই দামেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে অনেক চাষি এখনো আম ভাঙছেন না বাগান থেকে এই অবস্থা দেখে। কিন্তু যাদের টাকার দরকার বা আম পুষ্ঠ (পোক্ত) হয়ে গেছে তাদের ভাঙতেই হবে। কারণ পুষ্ঠ আম গাছে রাখা যায় না। ঝরে পড়ে গিয়ে বেশি ক্ষতি হবে। এর ওপর রয়েছে ঝড়-ঝাঁপ্টার নতুন করে ভয়।’

দুর্গাপুরের আমচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ঝড়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। তার পরেও আম বিক্রি করা যাচ্ছে না বাজারে তেমন ক্রেতা ও দাম না থাকায়। আবার গাছের আম নিয়েও শঙ্কায় আছি, যদি নতুন করে ঝড়-ঝাপ্টা হয় তাহলে এই সময়ে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সবমিলিয়ে এবার আমরা আমচাষিরা খুব শঙ্কায় আছি।’

বানেশ^র বাজারে আমের ব্যবসায়ী বাবু সরকার বলেন, ‘বাজারে কোনো বাইরের ক্রেতা নাই। আমরাই কিছু আম কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাচ্ছি। তারা যে দাম বেধে দিচ্ছেন, সেই দামেই কিনতে হচ্চে। তবে এবার আমের দাম অনেকটাই কম। বাজারে চাহিদা থাকলে জিনিসের দাম এমনিতেই বাড়ে। এবার তেমন চাহিদাও নাই বলে মনে হচ্ছে। ফলে পাইকাররা এখনো রাজশাহীমুখী হননি।’

আরেক ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘৩১ তারিখের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকেই। করোনার কারণে দেশের অবস্থা কি হবে, সেটি নিয়ে এখনো অনেক আম ব্যবসায়ী শঙ্কিত। এ কারণে বাইরের পাইকরারা আসছেন না। আমরাই আম কিনে পাঠিয়ে দিচ্ছি তাদের কাছে।’

প্রসঙ্গত, গত ১৫ মে থেকে রাজহশাহী বাজারে আম উঠতে শুরু করেছে। এরপর গত ২০ মে থেকে গোপাল ভোগ জাতের আম উঠছে। এবার জেলায় ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। তবে এবার এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মনে করছেন চাষিরা। তাদের দাবি এবার শুরুতেই আবহাওয়া ছিল বৈরী। এরপর আমের অফ সিজন। শেষে আম্ফানের তাণ্ডব। সবমিলিয়ে এবার আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।