কোরবানির পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা

কোরবানি শব্দটি আরবি, যার উৎপত্তি ‘কুরবুন’ থেকে। আভিধানিক অর্থ হল নৈকট্য লাভ করা।

ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আজহার দিন পশু জবাই করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।

কিন্তু প্রশ্ন হল, শুধু পশু জবাই করাই কি কোরবানির মূল উদ্দেশ্য? নাকি এর মাঝে আরও কিছু তাৎপর্য ও রহস্য লুকায়িত আছে। প্রতি বছর ঈদুল আজহা আমাদের কাছে নিয়ে আসে শিক্ষার অফুরন্ত সম্ভার; কিন্তু আমরা এটি নিছক একটি উৎসব বলেই মনে করি।

কতই না ভালো হতো যদি আমরা হজরত ইব্রাহিমের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ঘটনাকে পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম।

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হলে সর্বপ্রথম কোরবানির ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত হতে হবে। জানতে হবে ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা। এ কোরবানির প্রচলন দু’জন মহান ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।

সম্পর্কে তারা পিতা-পুত্র। একজন ‘আবুল আম্বিয়া’ তথা নবীদের পিতা নামে খ্যাত হজরত ইব্রাহিম (আ.)। অপরজন তার সুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)।

পারিবারিক শিক্ষা : হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশপ্রাপ্ত হলেন যে, তার চোখেরমণি, কলিজার টুকরা, প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য জবাই করতে হবে। নবীদের স্বপ্নও যে ওহি (প্রত্যাদেশ) তা হজরত ইব্রাহিম (আ.) বিলক্ষণ জানতেন। তাই সন্তান যতই প্রাণপ্রিয় হোক না কেন রহমানের নৈকট্য লাভে তাকে উৎসর্গ করতেই হবে। আল্লাহর সন্তুটি অর্জনের নিমিত্তে সব ধরনের আত্মত্যাগ শিরোধার্য।

তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। অতঃপর ইব্রাহিম (আ.) সন্তানকে নিয়ে জবাই স্থানের দিকে ধাবিত হলেন, সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.) কিছুই জানেন না, কোথায় কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন, পথিমধ্যে হঠাৎ ইব্রাহিম (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। ভাবনা-চিন্তা করে এ ব্যাপারে তোমার মত ব্যক্ত করো’।

এখানে কয়েকটি বিষয়ে একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা একাধিক পারিবারিক শিক্ষা পেতে পারি।

যেমন- হজরত ইব্রাহিম (আ.) একজন বিশিষ্ট নবী, আবুল আম্বিয়া তথা নবীদের পিতা, খলিলুল্লাহ তথা আল্লাহর প্রিয়বন্ধু, নব্বই বছর বয়সের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৬ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশু হজরত ইসমাইল (আ.) এর সঙ্গে আলোচনা করছেন। আর সেটি এমন একটি বিষয়ে, যে ব্যাপারে তিনি স্বপ্নে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত।

এ ঘটনা থেকে এটি বোঝা যায়, একজন পিতা হিসেবে তার সন্তানদের সঙ্গে কত সুমধুর সম্পর্ক থাকা উচিত। পিতা-পুত্র সর্ব বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করবে, এটিই কাম্য; কিন্তু পরিতাপের বিষয়- আমরা পিতা হয়ে সন্তানদের ওপর অধিকাংশ সময় সিদ্ধান্তের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে থাকি।

আর সন্তানের ওপরও এ দায়িত্ব বর্তায়- সে যেন নিজের পরিকল্পনা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা না করে সর্বপ্রথম পিতামাতার সঙ্গে ভাগ করে নেয়। যেমনটি হজরত ইউসুফ (আ.) স্বপ্ন দেখার পর করেছিলেন ‘যখন ইউসুফ পিতাকে বলল: পিতা, আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য এবং চন্দ্র আমার উদ্দেশে সিজদা করছে’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত-৪)।

এখানে আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, কোরবানি নিছক কোনো ব্যক্তিগত ত্যাগের নাম নয়। এটি পিতা, পুত্র ও মায়ের তথা একটি পরিবারের সমষ্টিগত ত্যাগের প্রতিফলন।

যেমন হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে একাকী এ কাজে অগ্রসর হননি। তার সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং স্বীয় পত্নী হজরত হাজেরা (আ.)।

এখান থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়, কোনো মুসলমান শুধু একা আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিলেই তা সর্বাত্মকভাবে সফল হবে না, বরং তার সম্পূর্ণ পরিবারকেও ত্যাগের পথে নিয়ে আসতে হবে। কেউ একা সংশোধিত হলে চলবে না, পরিবারের সবাইকে সৎ কাজে একে অপরকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে।

সামাজিক শিক্ষা : কোরবানির জবাই করা পশুর মাংস পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে বিলি-বণ্টনের মধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির শিক্ষা রয়েছে। কোরবানির পশুর মাংস দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করার মাধ্যমে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ তথা পারস্পরিক মমত্ববোধ তৈরি হয়।

নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং গড়ে উঠে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা। ঠিক এমনিভাবে কোরবানির জবাই করা পশুর চামড়ার বিক্রয়মূল্য গরিব, দুঃখী ও দুস্থদের হাতে তুলে দিলে তাদের সঙ্গে এক ধরনের সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ জন্মায় ও পারস্পরিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়।

আমরা সবাই জানি, পৃথিবীর সব প্রাণীর মধ্যে মানবজাতি আল্লাহর বিরল সৃষ্টি। কারণ প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে অপরের থেকে পৃথক। কোনো একটি বিষয়ে পাঁচজনের মতামত এক হওয়া কঠিন ব্যাপার।

সুতরাং একটি পশু সাতজন মিলে কেনাকাটা থেকে শুরু করে কোরবানির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একাধিক মতভেদ হতে পারে। সেই মতবিরোধগুলো ব্যক্ত না করে সাতজনকে মিলিতভাবেই কোরবানি সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যেই রয়েছে আত্মবিসর্জনের শিক্ষা। এখানেই লুকিয়ে আছে উদারতার বিরাট শিক্ষা।

ধনীর সম্পদে যেভাবে অসহায় মানুষের অধিকার রয়েছে, অনুরূপ কোরবানির পশুর মাংসেও অসহায়-গরিব-দুস্থ প্রতিবেশীর অধিকার রয়েছে। ঈদের সময় আমরা যেমন কোরবানির পশুর মাংস দুস্থদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করি, ঠিক তেমনিভাবে সবসময় দুস্থদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই কোরবানি সার্থক হবে।

নৈতিক শিক্ষা : কোরবানির পশুর মাংস সমান তিন ভাগে ভাগ করার মধ্যে অনেক বড় ধরনের নৈতিক শিক্ষা রয়েছে। ধনীর সম্পদের ওপর যেমন গরিব মানুষের হক রয়েছে, তেমনি কোরবানির পশুর মাংসেও গরিব, দুঃখী ও দুস্থ মানুষের হক রয়েছে।

এ মর্মে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর কোরবানির উটকে (পশু) আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো, যখন সেটি পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী সাহায্য চায়, তাদের খেতে দাও’ (সূরা হাজ্জ-৩৬)।

অর্থাৎ একজন ধনী বিত্তশালীর নৈতিক দায়িত্ব হল সে গরিব, দুঃখী ও দুস্থ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করবে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আত্মত্যাগ করেছেন। সুতরাং প্রত্যেক কোরবানিদাতার অন্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইলের (আ.) আত্মত্যাগ ও আত্মনিবেদনের শিক্ষা থাকতে হবে। নয়তো কোরবানির হাকিকত অর্জন হবে না।

কোরবানির একটি বিশেষ হাকিকত হল নিজের ভেতরে যে পশুশক্তি লুকিয়ে আছে, তা বিসর্জন দেয়া বা ত্যাগ করা। আত্মঅহঙ্কার-আত্মগরিমা বিসর্জনের প্রকৃত নামই হল কোরবানি।

কোরবানির পশু জবাই থেকে আমিত্ব বর্জনের শিক্ষা নিতে হবে। কোরবানির পশু জবাই হওয়ার মতো নিজের অন্তরকে আল্লাহর প্রীতি ও ভালোবাসা লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করে দিতে হবে।

সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে হতে হবে নিবেদিত প্রাণ। পাশবিক ও পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করে মানবিক গুণেগুণান্বিত হতে হবে। এটিই সুন্নতে ইব্রাহিমে ‘কোরবানির’ মর্মকথা।

ড. আবুল কালাম : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

সুত্রঃ যুগান্তর