কোটি টাকার মালিক রাজশাহীর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা রহিমের অপকর্ম চলছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তার বিরুদ্ধে রয়েছে নারী সহকর্মীকে লাঞ্চিত করার অভিযোগ। রয়েছে রাতারাতি নিম্নমাণের গম গুদামে ঢুকানোর অভিযোগ। পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পাহাড়সমান অর্থবিত্ত করার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনও চালাচ্ছে তদন্ত। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে বিভাগীয় মামলা। শাস্তিমূলক বদলিও করা হয় তাকে। কিন্তু এতসবের পরেও তিনি এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এরই মধ্যে তাঁর খাদ্যগুদাম থেকেই গোপনে পাচারের সময় গত ১০ ডিসেম্বর ওএমএস’র ১৭৬ বস্তা চাল আটক করেছে পুলিশ।

এ ঘটনায় সেই খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজস রয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর সেই তিনি হলেন রাজশাহী শহর খাদ্য শহর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) আব্দুর রহিম। তবে এখনো কোটিপতি এই খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তাঁর সমস্ত অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বহাল তবিয়তে থেকেই। তবে উচ্চ আদালত থেকে সকল অবৈধ কার্যক্রমের স্থগিতাদেশ নিয়ে তিনি আবার করছেন একের পর এক অপকর্ম।

অনুুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ ডিসেম্বর রাজশাহী শহর খাদ্য গুদাম থেকে ১৭৬ বস্তা ওএমএসের চাল বের করে নগরীর বহরমপুর এলাকার কাইউম নামের এক অজ্ঞাত ব্যক্তির ঠিকানায় যাচ্ছিল। এরপর পুলিশ পাচারের সময় ওই চালগুলো আটক করে। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত কাইউম ও খাদ্য বিভাগের অজ্ঞাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করে একটি মামলা করে।

নগরীর বোয়ালিয়া থানার একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই চাল পাচারের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে রাজশাহী শহর খাদ্য গুদামের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আব্দুর রহিম। এই অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই ওই চালগুলো পাচার করা হচ্ছিল উচ্চ দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে। তবে পুলিশ রাস্তায় সেই চালগুলো আটক করে। বিষয়টি নিয়ে দুদকও অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে।

নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি আমান উল্লাহ জানান, রাজশাহী শহর খাদ্য গুদাম থেকে বের করে পাচারের সময় ১৭৬ বস্তা চাল উদ্ধারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত চলছে। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করছে। তারা এসে এরই মধ্যে খোঁজ-খবর নিয়ে গেছে।

জানা গেছে, নারী সহকর্মীকে লাঞ্চিত করা, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে রাজশাহী সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহিমকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর। তাকে রাজশাহী থেকে বরিশাল আঞ্চলিক খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার অধিনে বদলি করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে।

এ নিয়ে ২০১৫ সালে দৈনিক একাধিক অনুসন্ধানী খবরও প্রকাশ হয় এর আগে। ওই খবরের পরিপ্রেক্ষিতেই আব্দুর রহিমের অপকর্মগুলো তদন্ত করে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়।

এদিকে দুনীর্তির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন, নারী সহকর্মীদের হয়রানি ও গম কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত আলোচিত খাদ্য কর্মকর্তা আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় খাদ্য অধিদফতর তাকে চাকরি থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই নির্দেশ দেয়া হয়। আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বর্হিভুত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুদকও তদন্তে নামে।

সংশিষ্ট সূএ ও খাদ্য অধিদপ্তরের চিঠি থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে রাজশাহী সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসিএরএসডি) হিসেবে রয়েছেন আব্দুর রহিম। এরপর ২০১৫ সালে ২৪ আগস্ট অধীনস্থ তিনজন নারী উপখাদ্য পরিদর্শক তার বিরুদ্ধ গুরুতর অসদাচরনের অভিযোগ করেন। আর এসব নারী কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি দেখোনো অসৌজন্যমূলক ও অপমানজনক কথা বলা এবং তাদের প্রতি অশোভন আচারণ করেছেন আব্দুর রহিম।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও প্রশাসন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুর রহিম তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারিদের বাদ দিয়ে গুদামের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের গুরুত্ব দেন। তিনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজ দায়িত্বশীল কর্মচারি মাধ্যমে না করিয়ে তার আত্বীয় গুদামের নিরাপত্তা কর্মী আসাদুজ্জামানের মাধ্যমে করান।

অভিযোগ রয়েছে আসাদুজ্জামানকে অন্য খাদ্যগুদামে থেকে রাজশাহী সদর খাদ্যগুদামে বদলি করে আনা হয় দুর্নীতি ও অনিয়ম করার জন্যই। রহিমের নামে খাদ্যগুদামে চাকুরির নীতিমালা সুস্পষ্ট লঘন করার প্রমাণও মিলেছে। মহাপরিচালকের চিঠিতে উঠে এসেছে রহিমের আরও অপকর্মের কথা। এসব কর্মকা-ের কারণে খাদ্য বিভাগে ভাবমূর্তি ক্ষুণ হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৮ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদনে যৌন হয়রানি, অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও গম কেলেঙ্কারীসহ বিভিন্ন অভিযোগের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক ( অনু ও তদন্ত-১) মোসা মাহফুজা খাতুন স্বাক্ষরিত ২০১৭ সালের ৭ মে একটি পত্রে রাজশাহী সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বর্হিভুত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন।

আব্দুর রহিমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তালিকায় রয়েছে, রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাসটার্মিনাল মার্কেটে তাঁর স্ত্রীর অত্যাধুনিক আবাসিক হোটেল ‘আনজুম ইন্টারন্যাশনাল’, একই মার্কেটের ১৫ টি দোকান এবং নওদাপাড়া বাসটার্মিনাল এলাকায় ৪০টি দোকান। এছাড়াও নগরীতে রয়েছে ৪ টি বাড়ি, ৬ টি প্লট এবং শ্বশুর বাড়ি নাটোরের লালপুর এলাকায় কয়েক কোটি টাকা মুল্যের শতাধিক বিঘা জমি। আব্দু রহিমের বিরুদ্ধে চাকরি বাানিজ্য, বদলি বানিজ্য ও চেক জালিয়াতির অভিযোগও তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

আব্দুর রহিমের সঙ্গে এসব নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এসব একসময় মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’

দুর্নীতি দমনের তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করে দুদক রাজশাহীর উপপরিচালক আব্দুল করিম বলেন, তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না।

এদিকে আব্দুর রহিমের নানা অপকর্মের বিষয়টি স্বীকার করে রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য কর্মকর্তাআব্দুস সালাম বলেন, ‘আব্দুর রহিমের বদলির একটি আদেশ হয়েছিল বলে জানি। কিন্তু তার ফাইলগুলো এখন ক্লোজ করে রাখা হয়েছে উচ্চ আদালতে রিট মামলা করার কারণে। আব্দুর রহিম উচ্চ আদালতে রিট মামলা করে তার বিরুদ্ধে গ্রহণকৃত সকল আদেশ এখন থেমে আছে।’