কোকো দ্বীপে চীনের সামরিক স্থাপনা যেভাবে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মাত্র ৫৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত মিয়ানমারের কোকো দ্বীপপুঞ্জ।

১৯৯০-এর দশক থেকে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানকার একটি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে বেইজিং।

সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের এক রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। চ্যাটাম হাউজের রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমার জান্তা সরকার কোকো দ্বীপের সামরিকায়ন ঘটাচ্ছে। বানানো হচ্ছে রাস্তা, বিমানের হাঙ্গার, ট্রেঞ্চ এমনকি একটি রাডার স্টেশনও। আর নির্মাণকাজে মিয়ানমারকে সহায়তা করছে চীন শ্রমিকরা।

তাদের ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সদ্য পাওয়া নির্ভরযোগ্য স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দ্বীপটিতে এখন অনেক বেশি কর্মকাণ্ড চলছে, যা ভারতের জন্য মোটেই সুখবর নয়।

কোকো আইল্যান্ডের অবস্থান একেবারেই ভারত নিয়ন্ত্রিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কোলঘেঁষে। কোকো দ্বীপ বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বীপগুলো তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের মিলনস্থলে।

কোকো আইল্যান্ড মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন প্রশাসনিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে তৈরি এ অঞ্চল। এর মধ্যে চারটি দ্বীপ অবস্থিত গ্রেট কোকো রিফের ওপর। বহুদিন থেকে এই কোকো দ্বীপপুঞ্জে ঘাঁটি তৈরির চেষ্টায় ছিল চীন। এখান থেকে নজরদারি চালানো হয় আন্দামান ও নিকোবরের দিকে। ভারতীয় বাহিনীর সামরিক কার্যকলাপে নজর রাখাই বেইজিংয়ের লক্ষ্য।

১৯৯৪ সালে এখানেই রাডার স্টেশন তৈরি করে নজরদারি শুরু করে চীন। শোনা গেছে, ওই বছরই কোকো দ্বীপপুঞ্জের পাঁচটি দ্বীপের মধ্যে দুটি চীনকে ইজারা দিয়েছে মিয়ানমার।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই সেদেশে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ক্রমশ বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে প্রভাব সবচেয়ে বেশি বাড়ছে চীনের।

সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটে তাদের আমদানি-রপ্তানি এবং জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য বিগত বহু দশক ধরেই চীনের নজর রয়েছে ‘মালাক্কা প্রণালী’র ওপর।

প্রায় ৮০০ কিলোমিটার লম্বা এই সামুদ্রিক রুটটি গেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ভেতর দিয়ে। চীনের জাহাজ এই মালাক্কা প্রণালী দিয়ে গিয়েই বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তাদের পণ্য নিয়ে যায়।

বিবিসি বলছে, মিয়ানমার যেহেতু এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটেও ভুগছে, তাই এই পটভূমিতে তারা চীনের জন্য উপযুক্ত একটি ‘মিত্র দেশ’ হিসেবে উঠে আসতে পারে। প্রতিরক্ষা খাতেও চীন বহুদিন ধরেই মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ, সেখানে বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রেও চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম।

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে গ্লোবাল ফরেন পলিসির শিক্ষক মেরি কালাহানের মতে, প্রশ্ন উঠছে কোকো আইল্যান্ড নিয়ে– সেখানে যে ধরনের কার্যকলাপ এখন চোখে পড়ছে সেগুলো কি আড়াল থেকে আসলে চীনই করাচ্ছে?

এটাও বলা হচ্ছে যে চীন সম্ভবত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই দূর থেকে তাদের ‘বন্ধু’ মিয়ানমারকে সাহায্য করছে। ভারত মহাসাগরের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে কোকো আইল্যান্ড অবশ্যই তাদের বিরাট কাজে আসবে।

বঙ্গোপসাগরে সামরিক নজরদারি (মিলিটারি সার্ভেল্যান্স) বাড়ানোর ক্ষেত্রেও যে এটি মিয়ানমারকে প্রভূত সাহায্য করবে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস-এর মিয়ানমারের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জসন টাওয়ার বলেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় সেনাবাহিনী বেইজিংয়ের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে নেবে এবং চীনের কৌশলগত উদ্যোগকে সমর্থন করবে।

কোকো আইল্যান্ড নির্মাণের বিষয়টি উত্তেজক। এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভবত বঙ্গোপসাগরে চীন ও ভারতের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে ভারত ও চীনকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াতে চাইছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সম্প্রতি কোকো আইল্যান্ডে এই কথিত তৎপরতা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে সব কার্যকরাপ প্রভাব ফেলতে পারে সেগুলোর ওপরে ভারত প্রতিনিয়ত নজর রেখে চলে।

কোকো আইল্যান্ডে চীন বা অন্য কোনও দেশ সামরিক স্থাপনা বানাচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার অবশ্য এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।

সামরিক সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল জও মিন তুন এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে বলেছেন, মিয়ানমার তার ভূখন্ডে কোনও বিদেশি সরকারকেই তাদের সামরিক ঘাঁটি বানাতে দেবে না। সূত্র; যুগান্তর