কেমন হবে ২০২২ সালের টেক দুনিয়া?

এ বছরও থাকছে করোনার প্রভাব
বছরের শুরুতেই বাতিল হলো ‘কনজিউমার ইলেকট্রনিকস শো’ বা ‘সিইএস’। যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে প্রতিবছরের শুরুতে এই প্রযুক্তির মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলেও কভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে এ বছরের আয়োজনটি বাতিল করা হয়েছে। শুধু অনলাইনে স্ট্রিমিং করেই সিইএসের প্রদর্শকরা নিজেদের নতুন সব প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা তুলে ধরতে পারবেন—এমনটাই বলেছেন সিইএসের আয়োজকরা। ফলে বেশ কিছু কম্পানিও এবারের সিইএস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে ফেব্রুয়ারিতে বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিতব্য মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস বা এমডাব্লিউসিও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় কি না তা নিয়েও থাকছে শঙ্কা। টানা ফ্লাইট বাতিলের ফলে নতুন প্রযুক্তিপণ্যের গবেষণা ও নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২২ সালজুড়ে চীনের সীমান্ত বন্ধ রাখার আশংকাও রয়েছে। সেটি যদি সত্য হয়, তাহলে নতুন প্রযুক্তির দেখা পাওয়াই মুশকিল হতে পারে নতুন বছরে।

কাটছে না চিপ সংকট
টানা তৃতীয় বছরের মতো চলমান থাকবে চরম চিপ সংকট। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানির (টিএসএমসি) একটি বড় কারখানা গত বছরের অক্টোবরে পুড়ে যাওয়ায় বছরের শেষে সংকট আরো প্রকট হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে রয়েছে ৭ ও ৫ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তাদের মনোপলি। সব চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই টিএসএমসির শিডিউল খালি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সে কাতারে শুধু পিসি ও স্মার্টফোন নির্মাতারাই নয়, রয়েছে গাড়ি ও অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিন নির্মাতাও। সেই সুযোগে টিএসএমসি তাদের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও রয়েছে গুঞ্জন। সব মিলিয়ে বলা যায়, চিপ সংকট নিরসনে স্বস্তির খবর এ বছরও পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি ইন্টেল ও এএমডি গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজের সঙ্গে তাদের স্বল্পমূল্যের প্রসেসরগুলো তৈরির ব্যাপারে চুক্তি করেছে। ফলে অন্তত বাজেট ক্রেতারা কিছু প্রসেসর ও জিপিউ নাগালের মধ্যে পেতেও পারেন। এদিকে কোয়ালকম আর অ্যাপল কম্পানি টিএসএমসির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় বাজারে নতুন ফ্ল্যাগশিপ অ্যানড্রয়েড ও আইফোনের সরবরাহ কম থাকতে পারে বলে জানা গেছে।

কোয়ালকম ও মিডিয়াটেকের নতুন ফ্ল্যাগশিপ প্রসেসর
প্রতিবছর নানা কম্পানির অগণিত মডেলের স্মার্টফোন বাজারে হাজির হলেও তাদের কেন্দ্র থাকে একই—সে বছরের সেরা কোয়ালকম বা মিডিয়াটেক প্রসেসর। মিডিয়াটেক কিছু বছর আগেও ফ্ল্যাগশিপ বা   উচ্চ-মাঝারি মানের ফোনে দেখা না গেলেও চলমান চিপ সংকটের ফলে বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। এ বছর কোয়ালকমের ফ্ল্যাগশিপ প্রসেসর হতে যাচ্ছে স্ন্যাপড্রাগন ৮ জেন ১। নতুন সিপিউটিতে থাকছে উচ্চগতির ৫জি নেটওয়ার্ক এবং ওয়াই-ফাই-৬ই মানের মডেম, যার মাধ্যমে ফোনে তারহীনভাবেই ব্যবহারকারীরা ১০ গিগাবাইট পর্যন্ত গতির ইন্টারনেট সুবিধা পাবেন। স্ন্যাপড্রাগন সাইট নামের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ইমেজ প্রসেসরও থাকছে এতে। ফলে বর্তমান ক্যামেরা হার্ডওয়্যারেও তিন গুণ বেশি মানসম্মত ছবি পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। সিপিইউ কোর থাকছে ৮টি, যার আর্কিটেকচার কর্টেক্স এক্স২, এ৭১০ এবং এ৫১০ মিশ্রিত ক্রাইয়ো মডেলের, গতি হবে ৩ গিগাহার্জ পর্যন্ত। জিপিইউ থাকছে এড্রিনো ৭৩০। এবারের জিপিইউতে রে-ট্রেসিং প্রযুক্তি থাকার কথা রয়েছে। মিডিয়াটেকের ফ্ল্যাগশিপ হতে যাচ্ছে ডাইমেনসিটি ৯০০০। এতেও উচ্চমানের তারহীন ইন্টারনেট প্রযুক্তি, শক্তিশালী ইমেজ প্রসেসর, মালি জি৭১০ ১০ কোর জিপিইউ এবং কর্টেক্স এক্স২ প্রযুক্তির অক্টাকোর সিপিইউ থাকবে। দুটি কম্পানিরই সিপিইউ তৈরি হবে ৪ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে। ফলে এ বছর কোয়ালকম আর মিডিয়াটেকের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে অনেকটাই।

ব্যবহারকারীদের হাতে ডিডিআর৫ র‌্যাম
অবশেষে ২০২১ সালের শেষভাগে ব্যবহারকারীদের হাতে পৌঁছাতে শুরু করেছে ডিডিআর৫ প্রযুক্তির র‌্যাম। ইন্টেলের ১২তম প্রজন্মের কিছু সিপিইউ এবং এএমডি রাইজেন ৬০০০ সিরিজের সঙ্গে ডিডির৫ র‌্যাম ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু এটি মাত্র শুরু। দ্রুতই সামনের দিনগুলোতে ৬০০০-৭০০০ মেগাহার্জ গতির ৬৪ গিগাবাইট বা আরো বেশি পরিমাণ র‌্যামযুক্ত ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ হয়ে যাবে মূলধারার, যেভাবে ডিডিআর৩ থেকে ৪-এ আসার ফলে ৪ গিগাবাইট র‌্যামের বদলে ৮ এবং ৮-এর বদলে ১৬ গিগাবাইট হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড। উচ্চগতির র‌্যাম ও এসএসডি ব্যবহারের ফলে পিসির সবচেয়ে বড় সমস্যা, ডাটা লোড ও সেভের জন্য ব্যয় করা বাড়তি সময় যাবে কমে। ফলে বাফার বা ক্যাশের প্রয়োজন হবে না। এ প্রযুক্তির সুফল সবচেয়ে বেশি পাবেন মিডিয়া নিয়ে কাজ করা প্রফেশনালরা, যেমন ভিডিও ক্যাপচার ও এডিটিং, থ্রিডি মডেলিং ও ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট নিয়ে যাঁরা কাজ করেন। তবে যাঁরা এখন ডিডিআর৪ সিস্টেম কিনছেন তাঁদের ভয় নেই, শিগগিরই বাতিল হচ্ছে না এ প্রযুক্তি।

জিপিইউ বাজারে ক্রিপ্টোর প্রভাব কমবে
বহুদিন ধরেই ইথেরিয়াম ফাউন্ডেশন বলে আসছে জিপিইউর ওপর তাদের নির্ভরতা কমানো হবে, ২০২১ সালের শেষভাগে সেটি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন তাঁরা। এ বছর সে পদক্ষেপগুলোর সুফল ধীরে ধীরে জিপিইউ বাজারে দেখা যাবে। জিপিইউ দিয়ে যাঁরা বড় বড় মাইন তৈরি করেছিলেন তাঁদের লাভের পরিমাণ কমে যাবে প্রায় অর্ধেক, ফলে ক্রিপ্টোর জন্য জিপিইউ ব্যবহারে কমে যাবে আগ্রহ। অবশেষে গেমার ও পেশাদারদের হাতে পৌঁছাতে পারে জিপিইউ, তবে চিপ সংকটের মাঝে দাম কতটা কমবে তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাইনিং যদি হয়ে পড়ে অলাভজনক, বাজারে প্রচুর মাইনিংয়ে ব্যবহৃত জিপিইউ পাওয়া যেতে পারে—এমনটা এর আগেও ঘটেছিল। সে ক্ষেত্রে ক্রেতাদের ব্যবহৃত জিপিইউ কেনার ব্যাপারে হতে হবে আরো সতর্ক।

আরো দ্রুতগামী এসএসডির আগমন
স্যামসাং তাদের নতুন পিসিআই-এক্সপ্রেস ৫ ভিত্তিক এসএসডি সম্প্রতি উন্মোচন করেছে। নতুন এসএসডির গতি বর্তমান পিসিআই-ই জেন-৪ এসএসডির প্রায় দ্বিগুণ, আর পাওয়ার ব্যবহার করবে বর্তমানের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম। এতে রিড স্পিড পাওয়া গেছে প্রতি সেকেন্ডে ১৩ গিগাবাইট এবং রাইট স্পিড প্রতি সেকেন্ডে ৬.৭ গিগাবাইট। র‌্যান্ডম আইওপিএস ২.৫ লাখেরও বেশি করা যাবে প্রতি সেকেন্ডে। পিসিআই-ই জেন-৫ এসএসডির যাত্রা স্যামসাংয়ের হাত ধরে শুরু হলেও সামনে অন্যান্য কম্পানির এসএসডির দেখা মিলবে, সন্দেহ নেই। শুরুতে শুধু ওয়েব হোস্টিং এবং ডাটা সেন্টারের জন্য এসএসডিগুলো তৈরি করা হলেও দ্রুতই সাধারণ ব্যবহারকারীদের হাতেও পৌঁছতে শুরু করবে এ প্রযুক্তি।

মেটাভার্সের বিস্তার
ফেসবুকের ভার্চুয়াল দুনিয়া বা ‘মেটাভার্স’-এর সঙ্গে কাজ করায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে অনেক প্রযুক্তি কম্পানি, বিশেষ করে যারা ভার্চুয়াল কনফারেন্স ও এক্সিবিশন করে থাকে, যেমন ‘সনি কম্পিউটার এন্টারটেনমেন্ট’, ‘দ্য আর্ডেন ইনস্টিটিউট’, ‘স্টেট অর প্লে’-এর মধ্যেই মেটাভার্সের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েও গেছি। মেটা তাদের নতুন অকিউলাস হেডসেট এ বছরের শেষে প্রচুর ইউনিট বিক্রিও করেছে, যার প্রমাণ অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের টপ লিস্টের একেবারে ওপরে রয়েছে অকিউলাস অ্যাপ অর্থাৎ এবারের বড়দিনে প্রচুর ক্রেতা প্রিয়জনদের উপহার দিয়েছেন মেটাভার্সের চাবিকাঠি এই হেডসেট। এ বছর মেটাভার্সের অগ্রযাত্রার প্রথম অংশ এরই মধ্যে হাজির হয়ে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার অভিবাসীরা হরাইজনস অ্যাপের মাধ্যমে নিজেদের অ্যাভাটার তৈরি করে মেটাভার্সের প্রথম ব্যবহারকারীদের সঙ্গে নতুন দুনিয়া ঘুরে দেখতে পারছেন।

স্পেসএক্সের স্টারশিপ
৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে ১ লাখ কেজি ওজন মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার মতো তৈরি যান নিয়ে কাজ করছে স্পেসএক্স। এ বছর সেটি প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলকভাবে মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনা করছে তারা। যদি সফল হয়, তাইলে স্টারশিপ হবে মানব ইতিহাসের সবচাইতে বড় মহাকাশযান। এর সবচাইতে বড় সুবিধা—রকেট ইঞ্জিন এবং মূল কেবিন দুটোই পুনঃব্যবহারযোগ্য। এতে করে মহাকাশে বড় জিনিস পাঠানোতে খরচ আসবে কমে। আগামীতে স্টারশিপের মাধ্যমেই মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর কথাও ভাবছে নাসা ও স্পেসএক্স।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ