কাঠমিস্ত্রির কণ্ঠে হুবহু মান্না দের গান, সংগীতপ্রেমীরা বিস্মিত

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

আমি যে জলসাঘরে, বেলোয়ারি ঝাড়, নিশি ফুরালে কেহ চায় না আমায়… ছেঁড়া শার্ট ও গামছা পরনে এক কাঠমিস্ত্রি হাতকরাত দিয়ে বাঁশ কাটতে গিয়ে সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ডুবলেন সুরে। তারপর গেয়ে গেলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি চলচ্চিত্রের এই গান। যে গান ঠোঁটে উঠেছিল উত্তম কুমারের আর নেপথ্যে গেয়েছিলেন মান্না দে।

মান্না দেকে নিয়ে সুরে ডুবে থাকা এই লোকের নাম আনন্দ রায়। দিনমজুরের বয়স কত হবে? চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ঘরে।  খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হালিয়া নামের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ রায় মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘরামির কাজ করে বেড়ান। আজ কার বাড়ির খড়ের চালা নষ্ট হলো, ঠিক করতে হবে; কাল কার বাড়ির বাঁশে ঘুণ খেল, বদলে দেওয়া; পরশু কার বাড়ির টিনের চাল দিতে হবে- মূলত এটাই পেশা আনন্দ নামের লোকটির। এ ছাড়া কাঠমিস্ত্রির কাজ তাঁর পেশার অংশ।

আনন্দ রায়ের ‘আমি যে জলসাঘরে…’ গানটি প্রযুক্তির কল্যাণে দেশের মূল সমাজের মানুষজন শুনতে পেয়ে অবাক হয়েছেন। সংগীতপ্রিয় মানুষেরা মুগ্ধ হয়েছেন। সোশ্যাল হ্যান্ডেলে অনেকেই গানটি শেয়ার দিয়ে দিয়ে নিজেদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন, অনেকেই আনন্দ রায়ের নামের সঙ্গে নানা বিশেষণ যুক্ত করেও গানটি অপরজনকে শোনার জন্য আকৃষ্ট করেছেন।

কামরুল হাসান নামের একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ফেসবুকে গানটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আমি অভিভূত একজন কাঠমিস্ত্রির কণ্ঠে মান্না দের গান। তার পরেও আবার এত সুন্দর মেলোডি নিয়ে…”

আমি যে জলসা ঘরে…

কে এই আনন্দ রায়? খোঁজ করার চেষ্টা করা হয় আনন্দ রায়কে। তাঁকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা গেছে। আনন্দ রায়ের ওই গানটি যিনি রেকর্ড করেছেন তাঁকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তরুণের নাম শুভ্র, যিনি ইউটিউবে লোকজ টিভির একটি চ্যানেল পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, তবে আনন্দ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

শুভ্র বললেন, ‘আমার সজল নামের এক ছোট ভাই রয়েছে, আমার সঙ্গে ও ইভেন্টের কাজ করে। ও-ই আনন্দ দাদা সম্পর্কে আমাকে বলে। এরপর আমরা মোটরসাইকেল নিয়ে খুলনা থেকে যাই। কিন্তু আনন্দ রায় যেখানে বসবাস করেন, সেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ অনেক খাল-গর্ত রয়েছে, সেসবের ওপর কোনো সেতু নেই। বাঁশের সেতু রয়েছে, যেটা দিয়ে মানুষ পারাপার হতে পারে। এরপর মোটরসাইকেল রেখে আমরা প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে, রিকশাভ্যানে বিভিন্ন মাধ্যমে পৌঁছলাম। তখন আনন্দ রায় একটি খালের সাঁকো বানানোর জন্য বাঁশ কাটছিলেন, আর আমি যে জলসাঘরে গাইতে শুরু করেছিলেন। আমি তাঁকে একটু থামতে বলে ক্যামেরা চালু করে দিলাম। আমার ক্যামেরায় ওই মুহূর্তের গাওয়া গানটি উঠে এলো।’

শুভ্র জানান, লোকটি দিনমজুর হিসেবে জীবন যাপন করলেও গানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রয়েছেন।  এই তরুণ বলেন, ‘উনি (আনন্দ রায়) এমন একটা জায়গায় থাকেন, যেখানে আশপাশের মানুষের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাঁকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হয়। আপনি বলার পরে তিন দিনেও তাঁর খোঁজ পাইনি। তাঁর নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোন নেই। ইচ্ছা হলে কাজ করেন, না হলে করেন না।’

শুভ্র জানান, রেডিও ছাড়া উন্নত কোনো ডিভাইসে তাঁর গান শোনা হয়নি। একটা সময় যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। সে সময়ই গান গলায় ধরতেন। মান্না দে, হেমন্ত তাঁর সব মুখস্থ। শুভ্রর ইউটিউব চ্যানেলে আনন্দ রায়ের অন্যান্য গান দেখে তা-ই মনে হলো। শুভ্র বলেন, ‘আমি হালিয়া গ্রামে এ পর্যন্ত পাঁচ দিন গিয়েছি। গান রেকর্ড করতে পেরেছি তিন দিন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি- কত গান মুখস্থ, তিনি সংখ্যা বলতে পারেন না। তবে যেকোনো গানের প্রথম লাইন বললেই তিনি সেটা গেয়ে ফেলতে পারেন সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে।’

শুভ্র নামের এই তরুণ বলেন, ‘আমি হয়তো তাঁর কিছু গান রেকর্ড করতে পেরেছি। একেবারে কাজ করতে করতে আড্ডা দিতে দিতে যদি তিনি এমন করে গাইতে পারেন, তাহলে পরিচর্যা নিলে নিশ্চয়ই অনেক ভালো গাইতে পারবেন। কণ্ঠে এমন সুর আর মেধা নিয়ে একজন মানুষ দেশের একপ্রান্তে অভাবের সঙ্গে লড়ছেন- এটা ভাবতেও খারাপ লাগে।’

কত দিন দেখিনি তোমায়… 

সূত্র: কালেরকন্ঠ