কর্তাদের দোষেই ভূমির মামলায় হারছে সরকার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পাকিস্তান আমলে চাঁদপুরের কচুয়ার তুলপাই ফতেপুর মৌজায় তুলপাই বাজারে সরকারের ৩৯.৫০ শতক জমির মালিকানা দাবি করে বসেন এক ব্যক্তি। এ নিয়ে মামলা হয় ১৯৬১ সালের ২৭ মার্চ। মামলায় ওই ব্যক্তির পক্ষে রায় হয় ১৯৬৯ সালের ১৪ অক্টোবর। নিয়ম অনুযায়ী রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আর আপিল করেনি। তারপর সেই দায়িত্ব চাপে বাংলাদেশ সরকারের কাঁধে। সরকারপক্ষ আপিল করে ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। তত দিনে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৪০ বছর। শুনানিতে উচ্চ আদালত সেই আপিল তামাদি বলে খারিজ করে দেন। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ওই ব্যক্তির নামেই জমিটির নামজারি করে দেয়।

 

 

আবার ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার নুরুল্লাগঞ্জ শেওজা এলাকায় সরকারের দশমিক ৬০ একর জমি নিয়ে মোশাররফ হোসেন গং ফরিদপুরের সহকারী জজ আদালতে মামলা করে। আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেন। তার সাড়ে ২২ বছর পর করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডে চিঠি পাঠায় জেলা প্রশাসন। তারও অনেক দিন পর ভূমি মন্ত্রণালয়কে তা জানায় ভূমি সংস্কার বোর্ড। তত দিনে মামলাটি তামাদি হয়ে যায়। ফলে উচ্চ আদালতে আপিল করে সরকারের পক্ষে ওই জমি ফেরত পাওয়ার পথ বন্ধ হয়।

 

 

এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহায়, সরকারপক্ষের আইনজীবীদের (জিপি ও এজিপি) গাফিলতিতে, দখলদারদের সঙ্গে সমঝোতার কারণে এবং সময়মতো আপিলের কাগজপত্র না পাঠানোয় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে এ বছরের ১৫ মে পর্যন্ত সাড়ে ১৬ বছরে ১১ হাজার ৩৯টি সরকারি ভূমিসংক্রান্ত মামলায় নিম্ন আদালতে সরকারপক্ষ হেরেছে।

 

 

জানা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো মামলার আপিল করার জন্য নিম্ন আদালতের রায়ের ২০ থেকে ৪০ বছর পরে উদ্যোগ নেওয়ায় উচ্চ আদালত আপিল বা রিভিশন গ্রহণ করছেন না। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে বারবার উদ্যোগ নেওয়ার ফলে কোনো কোনো মামলার আপিল বা রিভিশন উচ্চ আদালত গ্রহণ করলেও তামাদির কারণে তা সন্তোষজনক মনে না করে বেশির ভাগই নামঞ্জুর হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তার গাফিলতিতে সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি বেহাত হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এত দিন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। তবে দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর জারি  করা ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, সময়মতো কাগজপত্র না পাঠানোর কারণে কোনো মামলায় সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে বা সরকারের স্বার্থ সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও আইনি জটিলতা দেখা দিলে ওই কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানিয়ে একটি চিঠিসহ মামলার কাগজপত্র পাঠাতে হবে।

 

 

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সরকারি জমি বা সম্পত্তিসংক্রান্ত অনেক মামলার ক্ষেত্রেই সময়মতো কাগজপত্র না পাঠানোয় আপিল বা রিভিশন দায়ের করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা তামাদি হয়ে যাচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি, যাতে সংশ্লিষ্টরা সময়মতো মামলার নথিপত্র সলিসিটর শাখায় পাঠান। এখন আইন মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করেছে। পরিপত্র অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সময়মতো কাগজপত্র পাঠালে সব মামলার আপিল বা রিভিশন সম্ভব হবে। তাতে সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি বেহাত হওয়া ঠেকানো সম্ভব হবে।’

 

 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার তথ্য অনুযায়ী, সরকার যে ১১ হাজার ৩৯টি মামলায় হেরেছে তার মধ্যে রিট মামলা সাত হাজার ১৪১টি, সি/আর মামলা তিন হাজার ৩৮০টি, লিভ টু আপিল ২৫১টি, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের ১৮৬টি এবং কনটেম্পট মামলা ৮১টি।

 

 

ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, অতীতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও মাঠ প্রশাসনের অনীহার কারণে নিম্ন আদালতে সরকারের বিপক্ষে হওয়া রায়ের সার্টিফায়েড কপিসহ আপিল বা রিভিশন করার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র সময়মতো না পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে কারো অবহেলায় যাতে সরকারের সম্পত্তি বেহাত না হয়, সে জন্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জিপি ও সলিসিটর শাখার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদারকির জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জমিসংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা নিয়ম অনুসারে জেলাপর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা জিপি বা এজিপি দ্বারা পরিচালিত হয়। জিপি ও এজিপিদের কাছ থেকে আরো সেবা পাওয়ার জন্য তাদের কার্যক্রম জেলা প্রশাসকদের নিয়ন্ত্রণে আনার একটি উদ্যোগ ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ভূমিমন্ত্রী স্বাক্ষরিত একটি উপানুষ্ঠানিক পত্র আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

 

 

কর্মকর্তারা জানান, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের মামলাগুলো সলিসিটর শাখার মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর থেকে পরিচালিত হয়। সে হিসেবে মামলাগুলো সলিসিটর শাখায় পাঠানো হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলাগুলোসহ কনটেম্পট মামলার ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষাসহ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ আইনজীবী নিয়োগ করে সরকারি স্বার্থ রক্ষার যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীদের সম্মানীর হার সংশোধন করে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা মন্ত্রী অনুমোদন করেছেন। ভূমিসংক্রান্ত মামলায় সরকারের স্বার্থ রক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ আইনজীবীর একটি প্যানেলও গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তার অনুমোদন পাওয়া গেছে। শিগগির আইনজীবী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।

 

 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সারা দেশে সরকারের খাসজমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৫ হাজার ২১ একর। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৪ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৯০ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৮৫ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৯৭ শতাংশ এবং খুলনা ও রংপুর বিভাগের ৯৯ শতাংশ খাসজমি সরকারের দখলে রয়েছে। বাকি জমি নিয়ে হয় মামলা চলছে, না হয় বেহাত হয়েছে। মামলার আওতার বাইরে থাকা বেহাত সম্পত্তি উদ্ধারে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলাপর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে।

 

 

বিভাগীয় কমিশনারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে বেদখল হওয়া সরকারি সম্পত্তি থেকে ৯ হাজার ৯৪৯ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে।

 

 

ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশেই স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা সরকারি খাস জমি বা সম্পত্তি দখল করছে। স্থানীয় প্রশাসন দখলদারকে উচ্ছেদ করতে গেলেই তারা আদালতে মামলা করে। নিম্ন আদালতে ওই সব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারপক্ষের পরাজয় হয়। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে এ ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দখলদারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আদালতে সময়মতো উপযুক্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করেন না। সরকারপক্ষের আইনজীবীরাও বাদীর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নিয়ে মামলায় হেরে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিম্ন আদালতে হারের পর রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগে পাঠাতে হয়। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন পার করে রায়ের কপি পাঠান।

 

 

আইন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (প্রশাসন-১) মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, সরকারি স্বার্থ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তরসহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আদালতের দেওয়ানি, ফৌজদারি মামলার রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল বা রিভিশন দায়ের করতে হয়। একইভাবে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে, প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এবং হাইকোর্ট বিভাগের রিট মামলার রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করতে হয়। কিন্তু এসব আপিল বা রিভিশন করতে আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সলিসিটর শাখায় পাঠানো হয় না। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা তামাদি হয়ে যাওয়ায় আপিল বা রিভিশন দায়ের করা সম্ভব হয় না। আর সম্ভব হলেও তা তামাদির কারণে সন্তোষজনক না হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আদালত নামঞ্জুর করেন। ফলে সরকারি অনেক জমি বা সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে।

 

 

ভবিষ্যতে কোনো মামলায় নিম্ন আদালতে সরকারপক্ষের হারের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা আপিল বা রিভিশন দায়েরের জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পরিপত্রে নির্দেশ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। দেরিতে পাঠানো কাগজপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম ও পদবি উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানাতেও বলা হয়েছে।

সূত্র: কালের কন্ঠ