করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে স্লোভেনিয়াতে জোনভিত্তিক পরিকল্পনা!

মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া। প্রায় ৭,৮২৭.৪ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট এ দেশটিতে একুশ লক্ষের মতো মানুষের বসবাস। স্লোভেনিয়া উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, পশ্চিমে ইতালি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণে আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলের সাথে সংযুক্ত। ইউরোপের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অঞ্চল আল্পস, প্যানোনিয়ান প্লেট, ভূ-মধ্যসাগর ও ডিনারাইডসের মিলন ঘটেছে স্লোভেনিয়াতে এসে। স্লোভেনিয়া এক সময় লিবারেল কমিউনিমের ভিত্তিভূমি খ্যাত যুগোস্লাভিয়ার অংশ  ছিলো। ১৯৯১ সালের ২৫ শে জুন প্রথম কোনও দেশ হিসেবে স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে নিজেদেরকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। বিভিন্ন ধরণের সুউচ্চ পর্বতমালা, হ্রদ এবং স্কি রিসোর্টের জন্য স্লোভেনিয়া পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় নাম।

 


পৃথিবীর প্রায় ২১৫ টি দেশ ও অঞ্চলের মতো স্লোভেনিয়াও রেহাই পায়নি প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ছোবল থেকে। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রথম ধাপে স্লোভেনিয়া ছিলো করোনা মোকাবেলায় সফল এক রাষ্ট্রের নাম। পার্শ্ববর্তী দেশ ইতালিতে যেখানে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে সেখানে স্লোভেনিয়াতে করোনার প্রকোপ ছিলো অনেকটা মৃদু। এমনকি গত ১৫ ই মে ইউরোপের প্রথম কোনও দেশ হিসেবে করোনা মহামারির অবসানের ঘোষণা দিয়েছিলো স্লোভেনিয়া। গত মার্চ মাসের চার তারিখে স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু করে এ সময় পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিলো ১৪০০ এর কিছু বেশি। কিন্তু বিগত জুনের শেষ থেকে শুরু করে জুলাই কিংবা আগস্টের দিকে দেশটিতে নতুন করে আবারও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সীমান্ত সংযোগ স্বাভাবিক করার পর বলকান রাষ্ট্র বিশেষ করে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এ সকল দেশ থেকে স্লোভেনিয়াতে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে নতুন করে আবারও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তি থাকে। এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য স্লোভেনিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টগুলোতে জড়ো হতে থাকেন। অবকাশ যাপন শেষে তাঁরা যখন আবার স্লোভেনিয়াতে ফেরত আসতে শুরু করেন তখন তাঁদের অনেকের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। স্লোভেনিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যম এসটিএ বলছে লকডাউন চলাকালীন সময়ে এখানকার জনসাধারণ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়েছিলো, লকডাউন শিথিল পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকের মাঝে সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে খুব একটা সচেতনতা দেখা যায় নি। যেটি দেশটিতে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির আরও একটি কারণ।

ফার্স্ট ওয়েভে গোটা ইউরোপের মধ্যে স্লোভেনিয়া করোনা মোকাবেলায় নিজেদেরকে একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলো, অথচ সেকেন্ড ওয়েভে এসে দেশটির চিত্র পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। যেখানে প্রথম তিন মাস অর্থাৎ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল এবং মে এ তিন মাসে দেশটিতে মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ১৪০০ এর কিছু বেশি সেখানে বিগত দুই দিনেই দেশটিতে নতুন করে ১৪০০ জনের শরীরে কোভিড-১৯ এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় স্লোভেনিয়াতে নতুন করে ৭৪৫ জন প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, দৈনিক সংক্রমণ বিবেচনায় এ যাবৎকাল পর্যন্ত যেটি সর্বোচ্চ। প্রতিনিয়ত দৈনিক সংক্রমণের নতুন রেকর্ড হচ্ছে, অথচ ফার্স্ট ওয়েভে মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল এবং মে এ তিন মাসে দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিলো ৭০ জন। এছাড়াও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় স্লোভেনিয়াতে আরও একজনের মৃত্যু ঘটেছে। স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১০৬৮৩ জন, এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭৬ জন এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৫৬৮৯ জন।

 

দ্বিতীয় ধাপে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ ইতোমধ্যে স্লোভেনিয়াকে রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন থেকে স্লোভেনিয়া থেকে যদি কেউ এ সকল দেশে প্রবেশ করেন তাহলে তাঁদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে করোনা টেস্টের নেগেটিভ সনদ বহন করতে হবে। নচেৎ তাঁদেরকে ১০ থেকে ১৪ দিনের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। প্রতিবেশি দেশ হাঙ্গেরির সাথে বর্তমানে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ পুরোপুরিভাবে বন্ধ রয়েছে। ইতালি এবং অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি চেক পয়েন্ট সকল জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বাকি চেক পয়েন্টগুলো কেবলমাত্র অস্ট্রিয়া কিংবা স্লোভেনিয়া অথবা ইতালির নাগরিকদের ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।

সেকেন্ড ওয়েভে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে সমগ্র স্লোভেনিয়াকে রেড জোন এবং অরেঞ্জ জোন এ দুইটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। যে সকল এলাকায় তুলনামূলকভাবে সংক্রমণের হার বেশি সে সকল এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যদিকে যে সকল এলাকায় তুলনামূলকভাবে সংক্রমণ কিছুটা নিম্নগতির সে সকল এলাকাকে অরেঞ্জ জোনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পশ্চিম স্লোভেনিয়াতে অবস্হিত গোরিস্কা এবং প্রিমোরস্কা ও উত্তর-পূর্ব স্লোভেনিয়র কিছু অঞ্চলকে অরেঞ্জ জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে শুরু করে বাকি সব অঞ্চল রেড জোনের আওতাভুক্ত। শুক্রবার থেকে এ জোনিং সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্লোভেনিয়ার বর্তমান অর্থমন্ত্রী জিড্রাভকো পোচিভালশেকের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় ।

রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে আংশিকভাবে লকডাউন চালু থাকবে। বিশেষ কোনও প্রয়োজন ছাড়া রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে কেউ এক কমিউনিটি থেকে অন্য কমিউনিটিতে যাতায়াত করতে পারবেন না। উল্লেখ্য যে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য স্লোভেনিয়াকে অনেকগুলো ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা হয়েছে। একেকটি ক্ষুদ্র অংশ একেকটি কমিউনিটি হিসেবে পরিচিত। এমনকি কোনও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অরেঞ্জ জোন থেকে কেউ রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত কোনও এলাকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। তবে অরেঞ্জ জোনভুক্ত অঞ্চলগুলোতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। পাশাপাশি রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে সকল ধরণের বার, রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে কোনও রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে কেবলমাত্র পার্সেল খাবার বিক্রি করতে পারবে। এছাড়াও সকল ধরণের স্পোর্টস ইভেন্টের পাশাপাশি কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থানে এক সাথে দশ জনের অধিক মানুষের সমাগমের ওপর নিষেধাক্কা জারি করা হয়েছে। রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে বাহিরে বিশেষ করে উন্মুক্ত স্থানে যাতায়াতের  ক্ষেত্রে মুখে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক।  রেস্টুরেন্ট, বার কিংবা কফিশপগুলোতে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও সেলুন কিংবা পার্লারগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় নি। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সেলুন কিংবা পার্লারগুলোতে একই সময়ে সেবাদাতা এবং একজন খদ্দের ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তির উপস্থিতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

অরেঞ্জ জোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে সব কিছু স্বাভাবিক রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বার, রেস্টুরেন্ট ও কফিশপগুলো সেখানে যথারীতি খোলা থাকবে তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিবেচনায় কেবলমাত্র এ সকল বার, রেস্টুরেন্ট ও কফিশপগুলো কেবলমাত্র সকাল ছয়টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

স্লোভেনিয়ার বাম ও উদারপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো করোনা মোকাবেলায় সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তাঁরা দ্বিতীয় ধাপে করোনার  বিস্তার রোধ করতে পুরো স্লোভেনিয়াতে কঠোর লক ডাউন ও জরুরি অবস্থা আরোপের পক্ষপাতি। এমনকি এ মুহূর্তে সাময়িকভাবে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যদিকে স্লোভেনিয়ার অর্থমন্ত্রী জিড্রাভকো পোচিভালশেক বলেছেন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বিবেচনা করে এ মুহূর্তে পরিপূর্ণভাবে লক ডাউন আরোপ করা হচ্ছে না তবে পরবর্তীতে যদি দেশটিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আরও বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে হয়তো বা নতুন করে কঠোর কিছু পদক্ষেপ তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন