করোনায় কোমায় কিন্ডারগার্টেন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

চার-পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের কচিকণ্ঠে এক সময় মুখর থাকত যেসব কিন্ডারগার্টেন, করোনার কবলে সেগুলোর গেটে তালা ঝুলছে সাত মাস ধরে। বাইরের এ চিত্রের চেয়ে ভেতরের অবস্থা আরও করুণ। স্কুল বন্ধ, অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের ফি দিচ্ছেন না। ফলে বেতন হচ্ছে না শিক্ষক-কর্মচারীদের। দেওয়া যাচ্ছে না স্কুল ভবনের ভাড়াও। অনেক শিক্ষক ভাড়া দিতে না পেরে বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন।

স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল। খোদ রাজধানীতে এমন কয়েকটি কিন্ডারগার্টেনের খোঁজ মিলেছে, যেগুলোয় এখন শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে বাস করতে শুরু করেছেন। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্কুলের সামনে শাড়ি-কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক ভিত গড়ে দেওয়া কিন্ডারগার্টেনগুলো এমন ‘লাইফসাপোর্টে’ থাকলেও সরকারের কোনো সাড়া নেই। রাজধানীর সায়েদাবাদের ৬৫/৩ ব্রাহ্মণচিরণ নতুন সড়কে অবস্থিত ‘ব্রাইট স্টার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড হাই স্কুল’। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে কিন্ডারগার্টেন থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক। গত সোমবার

স্কুলটিতে গিয়ে দেখা গেল, স্কুলটির একটি কক্ষে পরিবার নিয়ে উঠেছে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন। গতকাল তিনি নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিষ্ঠানের ভবনের ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে তাকে। অন্যদিকে অভিভাবকদের কাছ থেকে কোনো টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। নিজে খাওয়ার চাল-ডাল কেনার কথা বলে শিক্ষার্থীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা এনে সংসার চালাচ্ছেন। ঋণে জর্জরিত হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন নিজের বাড়া বাসা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন স্কুলের শ্রেণিকক্ষে।

বাসা ছেড়ে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন ধলপুর কাজীরবাগে অবস্থিত আইডিয়াল প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান মিয়াও। তিনি বলেন, অনেক কষ্টের টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগ না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছি। আমার ছেলেও চাকরির পেছনে না ছুটে আমার প্রতিষ্ঠানেই সময় দিত। এখন আয় বন্ধ হওয়ায় একদিকে স্কুল ভাড়া, অন্যদিকে বাসা ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছি। ফলে স্কুলেই থাকার সিদ্ধান্ত নেই। স্কুলের সামনে থ্রি-পিস, শাড়ি বিক্রি করে এখন কোনোমতো চলছে সংসার।

তাদের মতো স্কুলে ঠাঁই নিয়েছেন রামপুরা মেমোরি টিউটোরিয়াল স্কুল, আদাবরের আঞ্জুমান রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এবং পপুলার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক। সারাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে ৬৫ হাজারের মতো। এগুলোয় শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় এক কোটি। করোনার কারণে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও আয়-উপার্জনহীনভাবে কতদিন টিকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। স্কুলগুলো বাঁচাতে সরকারের দ্রুত করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। আর্থিক প্রণোদনা অথবা ঋণ সুবিধা দেওয়ার আহ্বান তাদের। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে করণীয় নিয়ে ভাবছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্যপরিষদের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। এগুলো ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক কোটি শিশু পড়াশোনা করছে। শিক্ষা খাতে বিশাল অবদান থাকা সত্ত্বেও এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না।

কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাড়া বাড়িতে। মাসের প্রথমেই পরিশোধ করতে হয় বাড়িভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন। উদ্যোক্তারা এখন যেমন নিজেরাই সংকটে রয়েছেন, তেমনি বাড়িওয়ালা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের চাপও সামলাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় স্কুলের আংশিক ভবন ভাড়া দিয়েছেন কেউ কেউ। দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান করেছেন আত্মহত্যা। দিশাহারা কোনো কোনো উদ্যোক্তার স্কুল বিক্রির ঘোষণাও দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ঘাটতি রোধে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের রুটিরুজি স্বাভাবিক করতে পাঁচ দফা দাবি কিন্ডারগার্টেন উদ্যোক্তা ও শিক্ষকদের। সেগুলো হলো- অটোপাস না দিয়ে শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়া; স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন ভর্তির সুযোগ দেওয়া; প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা বা সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা; টিসিবিহীন (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আদেশ প্রত্যাহার করা; অন্য সব খাতের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর ব্যবস্থা করা।

কিন্ডারগার্টেনগুলোর সংকট প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এ ধরনের স্কুলের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অনিবন্ধিত। যে কারণে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। তবে যারা নিয়ম মেনে চলছে, তাদের বিষয়ে অন্তত একটা কিছু করা দরকার। এদের ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য বলে দিতে পারে সরকার। আমাদের শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে সরকার এটি করতে পারে। নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি শৃঙ্খলার মধ্যেও আসা উচিত সবার।

সরকারের শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে ত্রিপক্ষীয় সমস্যার উদ্ভব হবে। প্রথমত বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ব্যাহত হবে। দ্বিতীয়ত এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তায় পড়বে এবং তৃতীয়ত এসব প্রতিষ্ঠান যারা স্থাপন করেছেন, তারাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। সরকারের উচিত এখানে নজর দেওয়া। প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচাতে দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা বা বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে পারে সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, সরকার নন-এমপিও শিক্ষকদের জন্য করোনাকালে মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা, কর্মচারীদের আড়াই হাজার টাকা দিয়েছে। তাও প্রতিমাসে না একবার মাত্র দিয়েছে। এটি কোনোভাবেই একজন শিক্ষক পরিবারের জন্য সহায়ক নয়। সরকার শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী দিচ্ছে না। এমন হলে এ পেশায় মেধাবীরা আর ভবিষ্যতে আসবে না। সরকারের উচিত এত বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী যেসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে, তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ লেখাপড়া করছে। আমরা তাদের বিষয়ে আন্তরিক। আমরা চেষ্টা করছি তাদের দুঃসময়ের জন্য কী করা যায়। তবে ইতোমধ্যে যদি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়- নির্দেশনা দিয়েছি।

রাজধানীর ধানমন্ডির শাপলা একাডেমির প্রধান শিক্ষক হাসিনা আক্তার বলেন, আমরা শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেই পরের ক্লাসে দিতে চাই। অটোপাস অনেক অভিবাবক চান না। আর্থিক অভাবের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। অনেক শিক্ষক ইতোমধ্যে চাকরি ছেড়েছেন। অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। আয় রোজগার বন্ধের কারণে অনেক নারী শিক্ষকের পরিবারে বিচ্ছেদও ঘটেছে।

রোজ গার্ডেন টিউটোরিয়াল অ্যান্ড হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান সরকার বলেন, টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। কারণ কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলোয় সাধারণ ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত ভর্তি কার্যক্রম চলে। অনেক শিক্ষার্থী থেকে ভর্তি ফি, বইখাতা ইত্যাদির বকেয়া পাওনা রয়েছে। এখন শিক্ষর্থীরা যদি আমাদের টিসি ছাড়াই অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যায়, আমাদের আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে। আমাদের দাবি অন্য সব খাতের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর ব্যবস্থা করা।

এই স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শামসুন নাহার বলেন, করোনায় আমাদের আয় কমে গেছে। আমরা সরকারের কাছে তো দাবি জানিয়েছি টিউশন ফি মওকুফ করার জন্য। সরকার অটোপাস ঘোষণা দিয়েছে। আমি এপ্রিল মাস পর্যন্ত টিউশন ফি দিয়েছি। বাকি মাস থেকে বকেয়া আছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব ফারুক হোসেন বলেন, সরকার এক সময় আমাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল- এখানে চার বছরের শিশুদের পড়ানো হয়। ডায়েরি দিয়ে লেখাপড়ার হিসাব করা হয়। অভিভাবকদের নিয়ে সভা করে ইত্যাদি। অথচ সরকারও এখন এই পথে আসছে। তা হলে কেন এত অবহেলা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রতি? আমরা বেসরকারি খাতে শিক্ষায় বড় অবদান রেখে আসছি।

সূত্র: আমাদেরসময়