করোনার থাবা : রাজশাহীতে মে দিবসেও শ্রম বিক্রি ছাড়া উপায় নেই শ্রমিকদের

আমজাদ হোসেন শিমুল:

মহান মে দিবসের তাৎপর্য জানেন কাঠমিস্ত্রি শফিকুল ইসলাম। ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে কী ঘটেছিল তাও তার জানা। আজকের পহেলা মে’র আগে ইতোপূর্বের প্রায় ২০ টি মে দিবসে কাজ করেননি তিনি। কিন্তু করোনার কারণে লকডাউনে বেশ কয়েকদিন কাজ করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে মে দিবসেও রাজশাহী নগরীর টিকাপাড়া এলাকার একটি ফার্নিচার তৈরীর দোকানে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন শফিকুল। করোনাকালে মে দিবসেও শ্রম বিক্রি করা ছাড়া শফিকুলদের যেন কোনো উপায় নেই।

শনিবার (০১ মে) বেলা ১১টার দিকে ওই দোকানে দিয়ে গিয়ে কাঠমিস্ত্রি শফিকুলের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। শফিকুল বলেন, ‘করোনার কারণে বেশ কিছুদিন কঠোর লকডাউন ছিল। কাজ করতে না পেরে বাড়িতেই বসে ছিলাম। দুই সন্তান, বাবা-মা নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়। লকডাউনে বেশ কয়েকদিন বাড়িতে খাবার ছিল না। তাই এখন কাজ পেয়েও মে দিবসে ঘরে বসে থাকলে পরিবারের সবার পেটে বাঁধতে হবে পাথর। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই মে দিবসে কাজে এসেছি।’

শফিকুলের সঙ্গে কথা বলতেই ফার্নিচার তৈরীর দোকান মালিক মো. রনি দোকানে এসে উপস্থিত। প্রতিবেদককে দোকানের সামনে তার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেই বলে উঠলেন- “কাজের ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না’।’ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিলে শান্ত হয় রনি। মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় না খেয়ে থাকলে কেউ খোঁজ রাখে না। আমাদের যে শ্রমিক সংগঠন রয়েছে, এর নেতারা মাসে শুধু নির্ধারিত চাঁদাই শ্রমিকদের নিকট থেকে তুলেন। এছাড়া শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের বিষয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই মে দিবসে আমাদের কাজ না ঘরে বসে থাকলে কি আর চলবে?”

রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়া বটতলা এলাকায় বিল্ডিং তৈরীতে রড মিস্ত্রির কাজ করছেন উজ্জ¦ল। মে দিবসে কেন কাজে এসেছেন জানতে চাইলে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাড়ি আমার কেশরহাট। লকডাউনে কোনো কাজ করতে পারিনি। ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছিলো। সামনে আবার ঈদ। তাই পরিবারের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেয়ার জন্যই মে দিবসেও কাজে এসেছি।’

শনিবার (পহেলা মে) সকাল ৯টায় বাঘা থেকে সাইকেল চালিয়ে খাঁচা-কোদাল নিয়ে কাজের সন্ধানে রাজশাহীর তালাইমারী এলাকায় এসেছেন দিনমজুর আনারুল ইসলাম। তখনও কাজ পাননি তিনি। মে দিবসে কেন কাজে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিসের মে দিবস। আমি মে দিবস সম্পর্কে জানি না। লকডাউনে কাজ পাই না। প্রতিদিন রাজশাহী শহরে আসি কাজের সন্ধানে। কোন দিন কাজ পাই। আবার এমন কোন গেছে যেদিন কাজ না পেয়ে সাইকেলের প্যাডেল পেরে অভুক্ত অবস্থায় রিক্ত হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। আজও এমন দশাই হবে মনে হচ্ছে। এই বলে দু’চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে খাঁচা-কোদাল নিয়ে তালাইমারী থেকে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন আনারুল।’

নগরীর বাটারমোড় এলাকায় রাস্তার কাজে মে দিবসে ইট বহনের কাজ করছেন বাসন্তী রাণী (৪০)। শ্রম বিক্রিই তার পেশা। শুধু তিনিই নন, বাসন্তীর স্বামীও তাঁর মতোই শ্রমিক। বাসন্তী প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের পরিবার তাদের। ঘাম ফেলে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে দুই মেয়েকে বড়লেখাও করাচ্ছেন তারা। ছেলেটি ছোট। মে দিবসে কাজে এসেছেন কেন জানতে চাইলে বাসন্তী বলেন, ‘মে দিবস আবার কী বাবা? আমি এসব কিছুই বুঝি না। আমি শুধুই বুঝি ভোর বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে রাজশাহী শহরে কাজে আসা। সারাদিন পরিশ্রম করে যে দুই-তিন শত টাকা পাই, সেটি দিয়ে খাবার কিনে কুটির ঘরে গিয়ে সন্তানদের খাওয়াই।’

শুধু শফিকুল, রনি, উজ্জ্বল, আনারুল কিংবা বাসন্তী রাণীই নন; তাদের মত হাজার হাজার শ্রমিক আজ পহেলা মে দিবসে একটু খেয়ে-পড়ে বাঁচার জন্য রাজশাহী শহরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন শ্রমিকের কাজ করছেন। এমনিতেই গাড়িচালক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, দোকানদার, ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, ভ্যান কিংবা অটোচালক করোনা মহামারীর এই লকডাউনের কাজ না পেয়ে অনেকেই দিশেহারা। তাই খেটে খাওয়া কর্মজীবী এই মানুষেরা বলছেন- মে দিবসের প্রতি সম্মান রেখেই করোনা মহামারীর এই পহেলা মে-তে শ্রম বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।

উল্লেখ্য, প্রতিবছর ভিন্ন প্রতিপাদ্যে মহান মে দিবস পালিত হয়। আর এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিব বর্ষে গড়ব দেশ’। করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতে শনিবার (পহেলা মে) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস, যা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পরিচিত। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই দিন তাঁদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক- শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

এএইচ/এস