করোনায় রাজশাহীতে বন কর্মকর্তার মৃত্যু: গ্রাম লাশ দাফনের বিড়ম্বনা নিয়ে ইউএনও’র আবেগঘন পোস্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গত মঙ্গলবার (২ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান করোনা আক্রান্ত নওগাঁর নিয়ামতপুরের বাসিন্দা মৃত ওবাইদুল হকের ছেলে, কক্সবাজারে কর্মরত বন কর্মকর্তা শফিউর রহমান (৫৫)। তার মরদেহ দাফনে স্থানীয়ভাবে যে অসহযোগিতা করা হয়েছে তা নিয়ে নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়া মারিয়া পেরেরা রাতে ফেসবুক একটি পোস্ট দিয়েছেন। তার আবেগঘন পোস্টে এক বেদনাদায়ক ঘটনা ফুটে উঠেছে। সেটি সিল্কসিটিনিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

.
“কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মরদেহ নিয়ে রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে চারটি পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম), হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক চেয়েছিল। এগুলো কারও মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেও চলতো। কিন্তু দাফন কার্যক্রমে স্থানীয়ভাবে কোনো বিঘ্ন হতে পারে আশঙ্কা থেকে নিজে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলাম। নিজ আগ্রহ থেকে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সহকর্মী বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিল্লুর রহমান, থানার ওসি হুমায়ুন কবির এবং উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. শরিফুল।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু চারজনে খাটিয়াসহ লাশ বইতে পারছিলেন না। আরেকটু সহযোগিতার দরকার ছিল। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন যিনি পিঠে জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন এবং হাতে টর্চ লাইট বহন করছিলেন তিনি সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু তার পিপিই নেই। অতএব তাকে অনুমতি দিতে পারছিলাম না!

মৃতের ভাই বিকেল থেকেই পিপিই পরে ঘুরছিলেন। তাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাটিয়া বইতে সহায়তা করার অনুরোধ করলাম। বলামাত্র সেখান থেকে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেলেন! আর এলেন না। চারপাশে কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। অন্ধকারে ভুতুরে পরিবেশ! মৃত ব্যক্তির দুটো সন্তান কেঁদেই চলেছে। ওরা কাছেও আসতে পারছে না। ছটফট করছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চারজনে তখনও লাশের খাটিয়া ওঠানোর চেষ্টা করছে। ওঠানোর পর এগুতে পারছে না। আবার নামিয়ে ফেলছে। বেশ ভারী।

সদ্য প্রয়াত প্রিয় বাবার এমন অসহায় অবস্থা কোনো সন্তান মেনে নিতে পারে না। বড় সন্তান নাসিম যে এবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে সে কাতর কন্ঠে অনুরোধ করতে লাগলো সে খাটিয়া ধরতে সাহায্য করবে কি-না? কষ্ট হলেও তাকে ‘না’ বললাম।

আরেকটা পিপিইর ব্যবস্থা হলো। সেটা পরানো হলো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সেই সদস্যকে যিনি টর্চলাইট এবং জীবাণুনাশক স্প্রে বহন করছিলেন। তারা মিলে খাটিয়া উঠালেন। এবার টর্চ জ্বেলে সামনে পথ দেখানোর জন্য একজনকে খুঁজছিলাম। ডাকাডাকি করলাম। অনুরোধ করলাম। আত্মীয়-স্বজন কেউ এলো না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে শুধু একটা টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাবে এরজন্যও কোনো স্বজন রাজি হয় না!

যেহেতু জানাজা শেষ তাই ইমাম সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তাকেই বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে লাশ বহনকারীদের সহায়তা করার জন্য। তিনি অনুরোধ রাখলেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য আর ইমাম সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতায় অবশেষে দাফন সম্পন্ন হলো।

দাফন কার্যক্রমে আত্মীয়-স্বজনদের এমন আচরণ দেখে মৃতের স্ত্রী আর সন্তান দু’টো কতটা কষ্ট পেয়েছে অনুমান করতে আমার বুক কাঁপছে। ওরা ভাইবোন একে অন্যকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল। নাসিম চিৎকার করে লাশ বহনকারীদের বলছিল ‘ভাই ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন, তবু আব্বু যেন পড়ে না যায়।’

আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে আমিও বাবার জন্য এভাবে কেঁদেছিলাম। তবে পার্থক্যটা হলো আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পেরেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যহত নাসিম আর তার ছোট বোন তা পারেনি।”