কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি

নওগাঁ প্রতিনিধি:

বিশ্বসাহিত্যে অমর কথাসাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর মূল্যবান রচনা পড়লে মনের আকাশজুড়ে এক অনন্য নিদর্শন আকাশ তৈরি হয়। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ একাধিক বিষয়ে বই লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি, গণমানুষের কবি বন্দে আলী মিয়া। মা-মাটি-মানুষের প্রতি দরদ ফুটে উঠেছে তার সৃষ্টিকর্মে। গ্রাম নিয়ে তার অমর কবিতা-‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর/পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই/একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।’ কতিাটি পড়লে পাঠককে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে শৈশবে, যেখানে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ ফুটে উঠেছে তার ‘কলমিলতা’ কবিতায়: ‘বাতাস লাগিয়া দোলে নিরবধি কলমিলতা/পাতায় তাহার মাটির মনের গোপন কথা/বিহানের রোদে টলমল করে বিলের পানি/বুকে ভাসে তার রূপে ডগমগ কলমি রানী।’

উপমহাদেশের স্বনামধন্য কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর বন্দে আলী মিঞার ৪৩তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে একুশে পরিষদ নওগাঁ গত সোমবার (২৭ জুন) বিকেলে নওগাঁ সদরের শালুকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা ও আবৃত্তির আয়োজন করে। এসময় উপস্থিত ছিলেন কবি পুত্র জাহিদুল ইসলাম, একুশে পরিষদ নওগাঁ’র সহসভাপতি এম এম রাসেল, আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান স্বপন, দপ্তর সম্পাদক আবুদল মান্নান, হাপানিয়া আঞ্চলিক কমিটির প্রচার সম্পাদক রবিন হোসেন প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন শালুকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ। সভায় বক্তারা কবি জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। পরে শালুকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পঁচাত্তর জন শিক্ষাথীর অশংগ্রহণে আমাদের গ্রামসহ বেশ ক’টি আবৃত্তি করে।

তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। পাবনার রাধানগরে অবস্থিত কবির বাসভবনকে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মৃতি জাদুঘর-সংগ্রহশালা’ করার দাবি পাবনাবাসীর। কবির ছেলে জাহিদুল ১৯৮৪ সালে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মৃতি পাঠাগার’ গড়ে তোলেন। পাঠাগারটি নিবন্ধনভুক্ত। তবে নিয়মিত পর্যাপ্ত অনুদান না পেলে এটি চালানো তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান জাহিদুল। কবিপত্নী পরীবানুর বয়স বর্তমানে প্রায় ১০০ বছর। কবি বন্দে আলী মিয়ার নামে মাসে তিন হাজার টাকা সাহিত্য ভাতা পাচ্ছেন তিনি। এই বাজারে তিন হাজার টাকায় চলা খুবই কঠিন। তাই সরকারের কাছে ভাতা বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছেন কবিপত্নী।

১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের রাধানগর গ্রামে। পিতা মুনশি উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। বাংলা সাহিত্যে বিরল প্রতিভা ও সব পল্লিকবির মধ্যে অন্যতম ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যকীর্তিতে তিনি যে উচ্চতায় উঠতে পেরেছিলেন, তার জন্য তিনি মনে করেন তাঁর মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। মায়ের মুখের অফুরন্ত গল্প ও রূপকথা শুনেই বড় হচ্ছিলেন বন্দে আলী মিয়া। জীবনের শুরুতে প্রথাগত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। কয়েক বছর পর বন্দে আলী মিয়া বাংলাদেশের পাবনা শহরের মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়া শেষ হলে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে চিত্রবিদ্যায় ভর্তি হন কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে। চিত্রবিদ্যা নিয়েই ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়া প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পড়াশোনার সময় তিনি ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ওই সময় থেকেই উজাড় করে দিতে লাগলেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এটি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলো ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে, ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ নামে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা পাঠককেই মুগ্ধ করেছিল। সাহিত্য আলোচকদের মনেও দাগ কাটে ওই কাব্যগ্রন্থ। ওই সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন তিনি। বন্দে আলী মিয়ার রচিত লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রতিষ্ঠিতদের পাশে প্রকাশিত হতে লাগল। ‘ময়নামতির চর’ কাব্যটি পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চ প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়াকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ বিশ্বকবির ওই মূল্যায়ন সার্থক হয়। তিনি লেখালেখির জীবনে একটা দারুণ উৎসাহ পেয়ে গেলেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে বন্দে আলী মিয়ার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘অনুরাগ’ প্রকাশিত হলো। তারপর কবিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে লাগল ‘স্বপ্নসাধে’, ‘মৃগপরী’, ‘বোকা জামাই’, ‘লীলাকমল’, ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘মধুমতির চর’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবি শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পকলাতেও সুনাম অর্জন করেন। তিনি ছবি আঁকতেন মনের বিশাল ক্যানভাসকে ছবিতে উদ্ভাসিত করতে। গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্র চিত্রায়ণ থেকে পেশাদারি ছবিও এঁকেছেন তিনি অঢেল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগ কবিকে ছিন্নমূল করে দিল। অবশেষে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যান নিজ গ্রামে। বাংলাদেশে ফিরে তিনি বেকার হয়ে পড়লেন। বই লিখে ও ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। দেশভাগ কবি বন্দে আলী মিয়া মেনে নিতে পারেননি। ওই সময় তিনি গভীর বেদনায় ভেঙে পড়েন। তিনি চেয়েছিলেন দুই বাংলাকে একসূত্রে বাঁধতে। দুই বাংলার মিলন প্রয়াসে তাঁর রচিত সাহিত্য পড়লে আমাদের চিবুক চোখের জলে ভিজে যায়। কবি ‘কিশোর পরাগ’, ‘জ্ঞানবার্তা’ নামে শিশু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও সাহিত্যের প্রায় সব বিষয়ে তিনি বলিষ্ঠ বিচরণ করেছেন। কিন্তু আমরা তাঁর সাহিত্যসেবার সুফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি না কি! বাংলা সাহিত্যে এমন শক্তিশালী কবি ও সাহিত্যিক কম উঠে এসেছেন। তাঁর রচিত ‘পদ্মানদীর চর’, ‘দিবাস্বপ্ন’, ‘তাসের ঘর’, ‘মনের ময়ূর’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘ডাইনি বউ’, ‘রূপকথা’, ‘অরণ্য গোধূলি’ গ্রন্থ পাঠ করলে মনের আকাশ কার না সমৃদ্ধ হয়! তিনি যখন রেডিওতে চাকরি করতেন, তখন তিনি গল্পদাদু নামে শিশুদের মন জয় করে নেন। কারণ, বাচ্চাদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে এক অনুষ্ঠান।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি করার সময় বন্দে আলী মিয়া প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘দক্ষিণ দিগন্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। ‘কথিকা ও কাহিনি’ ও ‘ধরিত্রী’ নামে পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পায়। কবি নাটক রচনাতেও বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। ‘বৌদিদির রেস্টুরেন্ট’, ‘জোয়ার-ভাটা’, ‘গাধা হাকিম’, ‘উদয় প্রভাত’সহ আরও ১৪টি অতি উচ্চমানের নাটক পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতেও দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত কয়েকটি শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এসব গ্রন্থ পাঠ করলে বাচ্চারা এবং সব পথভ্রষ্ট মানুষ আদর্শ মানুষ হওয়ার রসদ পাবে বলে আমার বিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ ‘হযরত আবু বক্কর’, ‘হযরত ওমর ফারুক’, ‘হাজী মহসিন’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘ছোটদের সিরাজদৌল্লা’, ‘বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘মীর মশাররফ হোসেন’, ‘ছোটদের কলম্বাস’, ‘ছোটদের আব্রাহাম লিংকন’, ‘ছোটদের সোহরাওয়ার্দী’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘বেগম রোকেয়া’, ‘হিটলার’, ‘রাবেয়া বসরী’, ‘শরৎচন্দ্র’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

তাঁর রূপকথার গ্রন্থ পাঠ করে আমরা সমৃদ্ধ না হয়ে পারি না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সংগীত রচনাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানি তার পালাগান ও নাটিকা রেকর্ড করে বাজারে ছাড়ে। তার প্রায় ২০০ গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-ময়নামতির চর, অনুরাগ, পদ্মানদীর চর, মধুমতির চর, ধরিত্রী, অরণ্য, গোধূলী, ঝড়ের সংকেত। শিশুতোষ গ্রন্থ : চোর জামাই, মেঘকুমারী, মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ছোটদের নজরুল।

বন্দে আলী মিয়া রচিত গানের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কলগীতি’, ‘সুরলীলা’ প্রভৃতি। তাঁর গানের বইয়ে আমরা যেমন পাই পল্লিগীতি, তেমনি আছে দেশের গান, মরমি গান ও হাসির গান। বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁর গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন। গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, গল্পকথা, ছোটদের জন্য প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে যেমন, তেমনই সাহিত্যপথেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক পান। তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন রাজশাহীতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মূল্যবান সাহিত্য নির্মাণ বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ইতিমধ্যেই। বিশ্বজুড়ে কবি বন্দে আলী মিয়া ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁর বলিষ্ঠ ও সাহিত্যরসে পূর্ণ লেখার গুণে।

জি/আর